তোমার জন্যে শুভ্র গোলাপ, বেড়ালতমা -হামিম কামাল

 


এমন কৌতুককর দুঃস্বপ্ন আর দেখিনি। নরকের এমন স্বর্গীয় যাপনও কমই করেছি।

 

“বেড়ালতমা” নিয়ে বলছি, হাসান মাহবুবের উপন্যাস। সিপাহী রেজার অতিপ্রাকৃতিক প্রচ্ছদটা বলছিল, এ বই কোনো গভীর কালোর ভেতর নিয়ে গিয়ে আমাকে গোলাপের সৌরভ দেবে। প্রচ্ছদ সত্য হয়েছে। আমি সেই সৌরভ পেয়েছি। আমাকে এক পরাবাস্তব জগতের চাদর জড়িয়ে রেখেছে। এমন সুখ সুখ নরক শুধু তখনই অনুভব করেছি, যখন ও যতবার আমি কাফকা পড়েছি।

 

এবং কাফকা যেখানে থেমে গেছেন, হাসান মাহবুবের শুরুর বিন্দু ওটাই। কাফকার চরিত্রগুলো তাদের মনুষ্যত্বকে বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে। এবং সমাজের কাছ থেকে তার দণ্ড গ্রহণ করেছে। বেড়ালতমার কথকও মনুষ্যত্বকে প্রত্যাখ্যান করতে চায়। হাসান মাহবুবের লেখায় প্রধান চরিত্রগুলোর ভেতর যা সহজাত। তবে এখানে  আরো খানিকটা জল গড়িয়েছে। “বেড়ালতমা” আমাকে দেখিয়েছে, মনুষ্যত্বকে প্রত্যাখ্যানের যে চেষ্টা তা মূলত মনুষ্যত্বে ফিরে আসারই পথ। যেন একটা মানুষ বাড়ি থেকে পালাচ্ছে কারণ সে বাড়িতে ফিরে আসতে চায়। উপন্যাসটা এই পথে আমার কাছে দার্শনিক।

 

উপন্যাসগুলো যখন এমন পরস্পরবিরোধী  বিমূর্ত বাস্তবতা নিয়ে ডিল করে, রসশূন্য শুষ্ক হয়ে ওঠার সমূহ আশঙ্কা থাকে। "বেড়ালতমা" আমাকে অবাক করেছে এর একশ চৌষট্টি পৃষ্ঠার প্রতিটি বর্ণ ও অক্ষর গল্পরসে ভিজিয়ে রেখে।

 

মানুষ যে কারণে বই বন্ধ করে, সেই একই কারণে আত্মহত্যা করে। জীবন যখন একটা সুলিখিত গল্পের অনুভূতি দিতে থাকে, পরিণতি জানলেও মানুষ তার শেষ পাতা পর্যন্ত উল্টে যায়। প্রাচীন পুঁথিকাররা তো ট্রাজেডির শুরুতেই একটা অশ্রুভেজা ভূমিকা দিতেন। তবু শেষ বাক্য উচ্চারণ পর্যন্ত শ্রোতাদের কারো আসনপিঁড়ি টলত না। এর রহস্য রস।

 

“বেড়ালতমা” অদ্ভুত রসে ডোবা। ঐ যে বলছিলাম কৌতুককর দুঃস্বপ্ন, তার কৌতুকটুকু সাঁতার কাটছে এই অদ্ভুত রসে। এ উপন্যাস একইসাথে বীভৎস রসেরও একটা ধারা বয়ে নিয়ে গেছে কিছুদূর৷ তবে ওটা প্রধান হয়নি।

 

ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার সম্পর্কগুলোর ভেতর-বাহির বেশ বিচরণ করি। মহামারী চলাকালে যে কারণে এক পর্যায়ে আমি অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছিলাম। বিচরণের অভাবে। মানুষ নির্জন দ্বীপে হয়ত বাঁচতে পারবে, কিন্তু বাঁচতে চাইবে না। কারণ মূলত সে সম্পর্কবিচরী। অনেক বিচরণের পর সে ধীরে বিচরী থেকে বিচারী হয়ে ওঠে।

 

এই যে বিচরণ এবং বিচার, এ তার জীবনের অনেকটা দখল করে আছে। জীবন তার অনেকটা একে দখল করে রাখতে দিয়েছে কারণ, সম্পর্ক জীবনের রক্ষাকবচ। আর যা রক্ষা করে, তার সূত্র ধরেই হত্যা সহজতর।

 

“বেড়ালতমা”র যে কাবেরিনগর, সেই শহর তার নাগরিকদের জীবন যাপন দুরূহ করে রেখেছে। মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যে যেমন শারীরবৃত্তি দুরূহ, শহরের মৃত্যুর সময়ও নাগরিকদের শহরবৃত্তি দুর্বহ হয়ে ওঠে। সেই অর্থে বলা যায় কাবেরিনগর মৃত্যুপথযাত্রী। তার প্রাণময়তা প্রকাশ করার যে অল্প ক’টা জায়গা এখনো টিকে আছে, তার একটা হলো ঝিনুক হ্রদ। সেখানে এখনো সম্পর্কবিচরী প্রেমিক-প্রেমিকাদের সমাবেশ ঘটে। বয়স্ক আর শিশুরাও সেখানে আসে। দেখা যাচ্ছে ওটা সম্পর্কের বিচরণক্ষেত্র।

 

একটি বিশেষ পক্ষ ঝিনুক হ্রদের এই বিচরণক্ষেত্র নষ্ট করতে চায়। তার সূত্রধরে শহরকে ধ্বংস করতে চায়, যার সূত্র ধরে যে শহরের মানুষ ধ্বংস হবে। আর এই ধ্বংস এগিয়ে আনার জন্যে সেই পক্ষ অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেয়।

 

এই পর্যায়ে উপন্যাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের অবতারণা হয়েছে। গোলাপের খামারে বিরতিহীন তৈরি হতে থাকে কালোগোলাপ। এবং কৌশলে সেই গোলাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে তোলা হয় তাদের ভেতর, যাদের মধ্যে নিবিঢ় মধুর সম্পর্ক বজায় আছে।

 

যা কালো, তার সব রঙের অনুপস্থিতি। এই অনুপস্থিতি একটা কৃষ্ণগহ্বরের মতো। যেখানে যা আলো, তা সে শুষে নেয়। সম্পর্কের আলো শুষে নেওয়া এই কালোগোলাপের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বীভৎস। উপন্যাসের কথককে এই কালোগোলাপের খামারে কাজ করতে হয় বিধায়, আমরা এর ভেতরটা দেখতে পাই। গোলাপের উপকরণ হিসেবে তিনি মানুষের হৃদপিণ্ড কেটে বার করছিলেন।

 

হাসান মাহবুব শব্দ সৃষ্টি করেন বলে এর ক্ষমতা সম্বন্ধে সাবধান। নয়ত তিনি বীভৎসতা আরো বাড়াতে পারতেন। তীব্রতার স্বার্থে আমি বীভৎসতার দৃশ্যমানতা তৈরিকারী আরো শব্দের অভাব বোধ করেছি। ওই মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি, আমার ভেতর থেকে অন্য আমিকে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। সেই আমি কাবেরিনগরের নৃশংস পরিবেশে বসবাসের উপযুক্ত।

 

এমন আরো একটা ক্ষেত্র উল্লেখ করছি “বেড়ালতমা”র বাইরে। বার্জেসের উপন্যাস থেকে গড়া কুব্রিকের “আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ”। যখন ওটা দেখছিলাম, যেন চাইছিলাম সুন্দরের স্বার্থে অ্যালেক্সের বল্গাহীন অবোধ নৃশংসতায় আরো কিছু যুক্ত হোক।

 

কদর্যতার যে রূপ তারও পৈশাচিক সৌন্দর্যতৃষা আছে। আমাকে তার কাছে দাঁড় করিয়েছিল এরা ক্ষণিকের জন্যে হলেও।

 

“বেড়ালতমা”র কথক কদর্য সুন্দরের উৎকৃষ্ট উকিলে পরিণত হচ্ছিল। আমার মতোই, সেও একটা দুঃস্বপ্ন কৌতূহল নিয়ে দেখে যাচ্ছিল।  আমাদের বিবেকি সত্ত্বা স্বপ্নের বাইরে ছটফট ছটফট! এমন স্পর্শকাতর সময়ের আশ্রয় বেড়ালতমা; উপন্যাসের নাম-প্রটাগনিস্ট।

 

বেড়ালতমা ছিল সন্তানকেন্দ্রিক সাংসারিকতার স্বপ্ন দেখা মানুষ। একটা স্থির আয়ের নিশ্চয়তা, ছাদ খুঁজত। কিন্তু কথকের প্রাণসংশয়ী সবচেয়ে বড় বিপদে যে বেড়ালতমা শক্তিশেল ছুড়েছিল, সে কিন্তু আগের মানুষটা নয়। যেন তার পুনর্জন্ম হয়েছে। সুস্থ সাপের মতো যে নিজেই ছাড়াতে পেরেছে নিজের খোলস। 

 

আমার বিশ্বাস বেড়ালতমায় সাপ এসেছে বিশেষ সুমেরীয় পৌরাণিক তাৎপর্য নিয়ে। আদম-হাওয়া কেন্দ্রিক পুরাণের উত্তরাধিকারী ধর্মগ্রন্থ তোরাহ, বাইবেল আর কোরান যা করেছে, তা হলো স্বর্গে সাপের মাধ্যমে শয়তানকে আনিয়ে সাপকে করেছে ব্রাত্য। “বেড়ালতমা” সে পথ বাঁকিয়ে সাপের প্রতি মমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে এনেছে।  লেখক যেন মধ্যপ্রাচ্যকে ভারতবর্ষের পথ দেখালেন।

 

সুমেরীয় পৌরাণিকতা মেনে এখানে কথক (আদম) আছে, বেড়ালতমা (হাওয়া) আছে, চলে এসেছে সাপও। আর এমন সময়ে সাপ আত্মপ্রকাশ করছে যখন বেড়ালতমা “হবা” বা “হাওয়া” থেকে বিকশিত হয়ে হলেন “লিলিথ”। যিনি প্রকৃত “প্রথম নারী”। বেড়ালতমার এই বিকাশ আমাকে প্রভাবিত করেছে।

 

কাবেরিনগরের পর সাপের খামার অধ্যায় হলো একটু শ্বাস ফেলার মাঝবিরতি। এখানে নরকের ভেতর স্বর্গ যাপনের স্বাদ পেলাম। পরাবাস্তব ধূসর জোছনায় সাগরপাড়ে বেড়ালতমাকে নিয়ে বেড়ালাম, মদ পান করলাম। তবে ডিসটোপিয়ান ছুটি নিশ্চয়ই ফুলেল সুবাস ছড়িয়ে শেষ হবে না। হয়ওনি।

 

প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দম্পতি যত বেশি শক্তি সংগ্রহ করবে, তত বেশি নরকের উপযুক্ত হয়ে উঠবে, এটা অনিবার্য। সুতরাং কথক আর বেড়ালতমার চরিত্র-বিকাশ শেষ পর্যন্ত তাদের নরকের ট্রেনে চড়াবে এটা অবধারিত ছিল। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, “বেড়ালতমা”য় আমরা এক অভিনব নরক দেখতে পেলাম। আমার মনে হয়েছে চিরায়ত বর্ণনার চেয়ে যা বুদ্ধিদীপ্ত। পৃথিবী থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া ব্যথা সেখানে চক্রবৃদ্ধিতে বাড়ে। মানুষ তার বেদনাবোধের জ্বালানী। 

 

উপন্যাসের শেষে এক "আয়নার" সামনে দাঁড়ালাম। দেখি উপন্যাসের নাম “বেড়ালতমা” কেন উত্তর এখানে নিরুপদ্রব ঘুমোচ্ছে। আমি জাগাইনি তাকে। ঘুমন্ত মুখ দেখতে ভালো লাগে।

 

সম্পাদনার শেষ নেই। পরের সংস্করণে, গোলাপবাগানের মধ্যস্থতাকারীর সংলাপে আরো স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারেন বোধয় লেখক।  আর গোলাপবাগানের বহুরূপী মালিকটির মন কী করে কালো হয়ে উঠল? এর পেছনে নিশ্চয়ই মন কেমন করা কোনো গল্প আছে। আমি জানতে চাই। এটা জরুরি কারণ সেই গল্পের ভেতর কাবেরিনগরের ভবিষ্যত এন্টাগনিস্টদের বধসূত্র লুকিয়ে আছে।

 

“বেড়ালতমা”র জগৎ থেকে পাঠক আমি এখনো বের হইনি। হবো না। ঝিনুক হ্রদটা শেষতক বেঁচে গেছে। আগের মতো মানুষের তৈরি পরিপাট্য নেই, তবে প্রাকৃতিক বুনো সুন্দর নিয়ে ঝিলমিল করছে।

 

জগৎটাতে এখনো বেশি মানুষের দেখা তেমন পাইনি। তবে কাবেরিনগর দিকে দিকে ডাক পাঠিয়েছে। আমার মতোন অনেকেই জড়ো হবে শিগগির। ওরা সাপের খামারের সাগরধারে ক্যাম্পফায়ার করবে, দিনভর প্রেম করবে আর রাতভর করবে গান। পান করবে। শহরটা নরকের খাতিরে নরক হয়ে উঠবে না অনেকদিন।

 

তারপর হঠাৎ একদিন আমাদের ভেতর থেকেই কেউ ক্রমশ কালো হয়ে ‍উঠবে। আবার নতুন সংগ্রাম।  তখন অন্য কোনো বেড়ালতমা তার প্রেমাস্পদকে “প্রেরিতপুরুষ” করে পাঠাবে। তাকে অরক্ষিত রাখবে না। করুণাময় বাহুতে তাকে জড়িয়ে রেখে নিরন্তর আশ্রয় হয়ে থাকবে।

 

মহাকালের আয়নায় বিম্বিত ছবিটা চোখে ভাসছে। যখন আবারও আমি ভয়ার্ত হৃদয়ে তার কাছে ছুটছি, চোখজোড়া প্রেম প্রশ্রয় নিয়ে আমার দিকেও ঝরনার মতো নেমে আসছে বেড়ালতমা।

 

পরাবাস্তব এ উপন্যাস ২০২১ সালের বইমেলায় প্রকাশ করেছে পেন্ডুলাম। গায়ের দাম ২৮৫ ৳।

বেড়ালতমা কিনতে পাওয়া যাবে রকমারি থেকে। 




আলোচনায়- হামিম কামাল, লেখক

 

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

ইলুমিনাতি, একটি মার্কেটিং টুল; অথবা ছহি ইলুমিনাতি শিক্ষা

জ্বী না, সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়!