পাঠ প্রতিক্রিয়া- ফজলুল কবিরীর "ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া গল্প"


ফজলুল কবিরীর “ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া গল্প” একটি ছোট আকারের গল্পগ্রন্থ। পৃষ্ঠা সংখ্যা মোটে ৭২। ভেবেছিলাম অল্প সময়েই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু পড়তে গিয়ে বুঝতে পারলাম, এটা আমার আরো সময় এবং মনোযোগ দাবী করে। গল্পগুলোর প্রাপ্য আমি বুঝিয়ে দিয়েছি, এখন এ থেকে আমার কী প্রাপ্তি তা নিয়ে দুটো কথা বলা যায়। গল্প সম্পর্কে ধরে ধরে বলার চেয়ে লেখকের গল্প বিষয়ক দর্শন নিয়ে আলোকপাত করা যাক প্রথমে। তিনি ফ্ল্যাপে লিখেছেন, “গল্প অর্ধেক লেখকের, অর্ধেক পাঠকের। “ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া গল্প” মূলত মুক্ত বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া মৌলিক চিন্তা”। তার গল্প বিষয়ক দর্শন আমার ভালো লেগেছে। কারণ, আমিও ছোটগল্পকে এভাবেই দেখতে চাই। যেখানে শুধুমাত্র কাহিনী বলে দেয়া থাকবে না। থাকবে বহুমাত্রিকতা, ভাবনা এবং অনুভবের জায়গা। ফজলুল কবিরীর গল্পে কাহিনীর ঘনঘটা নেই, সংলাপ রচনার ক্ষেত্রে তার ভীষণ উদাসীনতা, এদিকে মেটাফর আর জাদুবাস্তবতা দিয়ে নীরিক্ষা চলতে থাকে। তার গল্পে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং বক্তব্য প্রকটভাবে থাকে, আমরা জানতে পারি, তিনি একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ ধারণ করেন, এবং সেটি দৃঢ়তার সাথে বলে যেতে চান। এটা নিঃসন্দেহে সাহসের ব্যাপার, কিন্তু গল্প রচনায় সাহস এবং দৃঢ়তাকে প্রকট করে তুললে নান্দনিকতা অনেক সময় প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। তার গল্পে এ ব্যাপারটি মাঝেমধ্যেই হয়েছে।
প্রথম গল্পটিতেই যেমন, “মানবজন্মের বেড়ি”তে কথকের সাথে তার ছায়ার সংলাপ একটি চমৎকার বিমূর্ত আবহ তৈরি করেছিলো, তাদের কথাবার্তায় একটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিতে তার ক্ষরণ অনুভব করা যাচ্ছিলো, তার যাপিত জীবনের অপ্রাপ্তি রচনায় যথেষ্ট গুমোটভাব বজায় ছিলো, “সাবলেট থাকা বাড়িতে সঙ্গমের সময় মুখ চাপা দেয়া”র মত মোক্ষম বাক্যে,
কিন্তু “এতকিছুর পরেও দিনের পর দিন মানুষ ধর্মান্ধ যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলে যাচ্ছে”, এখানে লেখককে কেমন যেন প্রাবন্ধিক মনে হয়, “কিন্তু এরপরেও এদেশকে মুক্ত করার শপথ নিয়েছিল নিরক্ষর চাষাভুষারা”, এখানেও।
পুরো বইয়ের মধ্যে এই গল্পটিই সবচেয়ে সরল এবং অকপট। ছায়ার সাথে কথোপকথন একদম প্রারম্ভিক পর্যায়ের অধিবাস্তবতা। পরবর্তী গল্পগুলিতে আমরা আরো কুশলী প্রয়োগ দেখতে পাই।
তবে বইয়ের প্রথম অর্ধেক গল্পে বিষয়বস্তুর বৈচিত্রহীনতা হতাশাজনক। এই ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধ, ঘুরেফিরে প্রায় একইরকম গল্প। প্রতিটাই আলাদাভাবে পড়তে গেলে ভালো, কিন্তু পরপর পড়লে কিছুটা ক্লান্তি ভর করে। “উরু এবং অস্থির আখ্যান” গল্পটি এদিক দিয়ে অন্যরকম, কিন্তু এর কাহিনী এবং আঙ্গিক সাদামাটা। জৈবিক ক্ষুধা মেটাতে হোটেলে এসে নিজের হারিয়ে যাওয়া কন্যার সন্ধান পেয়ে যাওয়া, এ ধরণের ধাক্কা এর আগেও অনেক গল্পে, সিনেমায় পাওয়া হয়ে গিয়েছে। তাই এ আর নতুন কিছু মনে হয় নি।
“প্রাচীন রক্তের সুবাস” গল্পটিও লেখকের রাজনৈতিক চিন্তার কাঠামোতে আবদ্ধ, তবে এখানে জাদুবাস্তবতার সুস্বাদ আছে।
‘সেটেলার’ গল্পটিতে তিনি পাহাড়ের বুকে বাস করা আদিবাসীদের নীপিড়িত হওয়া নিয়ে লিখেছেন, এই সাহস দেখানোর জন্যে তিনি ধন্যবাদ অবশ্যই পাবেন, তবে এখানে ঠিক গল্প পাই নি, শুধু বক্তব্যই পেয়েছি।
“জোছনা ও আত্মজা” গল্পটি সম্পর্কে মন্তব্য করছি না, পাঠের সময় আমার মনোযোগে ঘাটতি ছিলো। “আগন্তুক, কুকুর, এবং কোলাহল” গল্পটাতে টেনশন ভালো ছিলো, কিন্তু সমাপ্তিটা বড় বেশি বক্তব্যনির্ভর।
তো এই হলো আমার কাছে বইয়ের প্রথম ভাগ, যা আমাকে খুব একটু টানে নি। মনে হচ্ছিলো লেখক সমাজের প্রতি বিশাল দায়ভার মাথায় নিয়ে লিখতে বসেছেন, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা এবং বিভেদ দূরীকরণে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে চান। সেক্ষেত্রে “প্রাচীন রক্তের সুবাস” ছাড়া আর কোনোটিই আমার কাছে একইসাথে নান্দনিকতা এবং দায়বদ্ধতার সুষম মিশ্রণ মনে হয় নি। “প্রাচীন রক্তের সুবাস” একটি চমৎকার গল্প।
গ্রন্থের দ্বিতীয়ভাগে লেখককে অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং ডাকাবুকো লেগেছে! “অজগরের খোলস” গল্পে ‘সেটেলার’ গল্পের অপ্রাপ্তি ঘুচেছে। উহ্লাচিংদের এলাকায় সেলিমদের ভ্রমণকে একটা অনুপ্রবেশ বলেই মনে হয়, এবং তা কৌতুককর হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে গিয়ে অজগরের ফেলে যাওয়া খোলসে পা আঁটকে থরথর করে কাঁপতে থাকায়। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতপূর্ণ সমাপ্তি, যাতে কুশলতার সাথে একটি বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে। ডার্ক হিউমার বরাবরই আমার পছন্দের বিষয়।
“কচি ইঁদুরের রক্ত” গল্পটিতেও বক্তব্য, মেটাফর এবং ডার্ক হিউমারের চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে। শহুরে নাদুসনুদুস মানুষজনের প্রকৃতির কাছাকাছি এসে মওকা লুটতে যাওয়া, টাক ঢাকতে কচি ইঁদুরের রক্ত খোঁজা, অগ্নিকান্ড, ইঁদুরদের আক্রমণ, সব মিলিয়ে একটি তৃপ্তিকর জাদুবাস্তবতা পাঠ।
“গিলাফ ফকিরের খিলাফত” গল্পটিতে ফকিরের কাছে কুমারী মেয়ে নিয়ে আসার পর তাদের গর্ভবতী করে দেয়ার পর বিয়ের বাজারে ভালো মূল্য পাওয়া, এটা কি কোনো সামাজিক প্রথা, নাকি লুকোনো কোনো জাদুবার্তা, বুঝি নি।
“বাঘের চোখ” আমার কাছে এই বইয়ের অন্যতম সেরা গল্প। মেটাফর এবং টুইস্টের প্রাচুর্যে ঝলমল এই গল্পটি উর্দিপরিহিত ক্ষমতাধরদের প্রতি চরমতম বিদ্রুপ প্রকাশের পাশাপাশি অতি শক্তিশালী রূপক বক্তব্যও প্রকাশ করেছে, যা পাঠে শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে আমাদের এবং আমাদের আগলে রাখা প্রকৃতিমাতার অশুভ পরিণতির কথা মনে করে।
“টিকটিকির খাঁচা” আঙ্গিকের দিক দিয়ে অনেকটা প্রথম গল্পের মতই। সেখানে ছিলো ছায়ার সাথে কথোপকথন, আর এখানে টিকটিকির চোখে বন্দী। সেখানে ছিলো রাজনৈতিক সংকট, এখানে একান্তই ব্যক্তিগত সংকট। স্বপ্ন ভাঙার পর চিত হয়ে পড়ে থাকা টিকটিকি এবং মলিন দুটো ক্রাচের পাহারা এক ধরণের হাহাকার তৈরি করে বুকে।
ফজলুল কবিরী গল্প নিয়ে ভাবেন, এবং সময় দেন অনেক, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তিনি মৌলিক চিন্তায় আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠুন, এবং পাঠকের সাথে একটি চমৎকার ভাবনাসেতু তৈরি করুন এই কামনা করি।
বইটি পাবেন এখানে- https://www.rokomari.com/bo…/160978/fu-diye-uriye-dewa-golpo
এবং অনলাইন বুক শপ বইয়াল এ।

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মুভি রিভিউ 'মাদার' এ্যারোনোফস্কির মেইনস্ট্রিম ওয়ান্ডার!

জ্বী না, সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়!