প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!
আমার
বাবা-মা চাইতেন, আমি বড় হয়ে ডাক্তার হই। কিন্তু আমার বায়োলজি ভালো লাগতো না।
সেজন্যে ইন্টারমিডিয়েটে বায়োলজি বিষয়টাই বাদ দিয়ে দেই! জীবনে প্রথম নিজের
সিদ্ধান্তে বড় কোন কাজ! মামনি বেশ আশাহত হয়েছিলেন। তবে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম।
আমাদের কলেজের কম্পিউটার শিক্ষার ম্যাডাম খোলা হাতে নম্বর দিতেন। জীবনের এই
সন্ধিক্ষণে এসে আমার বোধোদয় হলো। নাহ, মানবসেবার এই মহান পেশায় নিজেকে নিয়োজিত না
করে কী ভুলটাই না করেছি! ভুল শুধরানোর কি কোন উপায় নেই? আছে বটে! একটু কষ্ট করলেই
যে কেউ হোমিও ডাক্তার হয়ে যেতে পারে! আহ, হোমিওপ্যাথি! অনেকদিন ধরেই হোমিওপ্যাথি
নিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করছি। শুধু নেটে ঘাঁটি নি, অনেকের সাথে কথাও বলেছি। এর মধ্যে
আছেন মূলধারার চিকিৎসক (হোমিওপ্যাথরা যাকে বলে এ্যালোপ্যাথিক), আছেন হোমিও ধারার
চিকিৎসক, আছেন মূল ধারার চিকিৎসা থেকে আলোর পথে, মতান্তরে হোমিওর পথে ফিরে আসা
চিকিৎসক, শখের হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক, হোমিওপ্যাথির স্টুডেন্ট, আরো অনেকেই। এতসব কিছু করে আমি কী সিদ্ধান্তে এসেছি, সেটা
বলে ফেলি। হোমিওপ্যাথি একটি অপচিকিৎসা। আমি খোলা মন নিয়েই লেখাটা লিখছি। আপনারা
যদি পারেন, এই সিদ্ধান্ত বদলের জন্যে প্রয়োজনীয় প্রমাণ দিবেন, আমি মেনে নেবো।
(১)
কী ,
কেন কীভাবে
হোমিওপ্যাথি
সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু কথা বলে নেয়া যাক। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির আবিষ্কারক
জনাব স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। জার্মানির এই ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য ছিলো মহৎ। সেই সময়
চিকৎতসা ব্যবস্থার অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। তখন বিশ্বাস করা হত, চার প্রকার তরল (কালো, হলুদ, রক্ত এবং
কফ) এর তারতম্যই যত রোগের কারণ। এই অদ্ভুত তথ্য অনুসারে অদ্ভুত সব চিকিৎসা করা হত।
হ্যানিম্যানের এই অবস্থা ভালো লাগে নি।
তিনি ভালো কোন চিকিৎসা পদ্ধতি বের করতে চেয়েছিলেন। এ করতে গিয়ে একদিন তিনি সিনকোনা
গাছের রস খেয়ে ফেললেন। এতে করে তার কম্প দিয়ে জ্বর এলো। যা অনেকটা ম্যালেরিরা
রোগের উপসর্গের মত। তখন তার মাথায় বুদ্ধি এলো। যা দিয়ে রোগের উৎপত্তি, তা দিয়েই
রোগ নিরাময় সম্ভব। তিনি সবাইকেই সিনকোনা পাতার রস খাইয়ে দিলেন, দেখলেন সবারই কম্প
দিয়ে জ্বর আসছে। এরপর তিনি রোগ সারানোর জন্যে করলেন কী, অতি অল্প মাত্রায় সিনকোনা
পাতার রস খাইয়ে দিতে লাগলেন পানি অথবা এ্যালকোহলের সাথে দ্রবীভূত করে। তিনি কোত্থেকে যেন কিছু তত্ত্ব বানিয়ে ফেললেন, যার
কোন ভিত্তি এখনও পাওয়া যায় নি।
তত্ত্ব-
১- Like cures like- অর্থাৎ যা দ্বারা রোগের সৃষ্টি তা দিয়েই রোগের উপশম।
তত্ত্ব-২ সেই বস্তুটিকে পানি বা
এ্যালকোহলের সাথে মিশিয়ে লঘু করে খাওয়াতে হবে। ঔষধ যত লঘু, তত তার শক্তি বেশি। শুধু
মেশালেই হবে না, ঝাঁকাতেও হবে। না ঝাঁকালে ঔষধের পাওয়ার বাড়বে না!
তত্ত্ব-৩ পানিতে মিশতে মিশতে তো একটা
সময় বস্তু প্রায় থাকবেই না! সেক্ষেত্রে উপায়? Water
memory নামক এক
তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। মানে হলো গিয়ে, পানি তার স্মৃতিতে ধরে রাখে ঔষধের গুণাবলী।
এরপর
থেকে হ্যানিম্যানের কাজ দাঁড়ালো লক্ষণ বিচার করে ঔষধের তালিকা প্রস্তুত করা।
মেটিরিয়া মেডিকা নামক এক কিতাবে তিনি এগুলো লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন, যা পরবর্তীতে
হোমিওপ্যাথির মূল বই হিসেবে পঠিত হয়।
তো
চিকিৎসা বিজ্ঞানের সেই ভয়ংকর দুঃসময়ে হোমিওপ্যাথি ভালোই গ্রহণযোগ্যতা পেলো। মানে
ধরেন রক্ত বের করে ফেলা, চুষে নেয়া জাতীয় ভয়াবহ চিকিৎসার চেয়ে তো হোমিওপ্যাথি অনেক
ভালো! চিকিৎসক সময় নিয়ে রোগের বিবরণ শোনেন, অনাচার-অত্যাচার করেন না, ঔষধ দেন,
রোগী সন্তুষ্ট। মানুষের শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা রোগ সারিয়ে দিচ্ছে,
সাথে যুক্ত হচ্ছে প্লাসিবো (Placebo) ইফেক্ট। প্লাসিবো ব্যাপারটা
এমন, সাময়িক উদ্দীপনা অনুভব করে ভালো বোধ করা। ধরেন আপনার শরীর খুব খারাপ লাগছে।
এই সময় আপনার প্রিয় একজন মানুষ এসে সুন্দর সুন্দর কথা বলে গেলো, আর এক পিস আঙ্গুর
খেতে দিলো। আপনি ভালো বোধ করলেন। তো এই ভালো বোধ করাটা কিন্তু আঙ্গুরের কারণে না,
প্রিয় মানুষের ভালো ব্যবহারের কারণে। এখন এই আঙ্গুরটাকে যদি আপনি ঔষধ হিসেবে নেন,
তাহলে আপনার এই ভালো বোধ করার প্রতিক্রিটাই হলো প্লাসিবো।
হ্যানিম্যানের
ঔষধ লঘুকরণ সূত্রে চলতো। কিন্তু কতটা লঘু করা হতো, জানেন? খুব বেশি না এই ধরেন
যতটুকু ১০^৩০ ভাগ পানি বা এ্যালকোহলের সাথে ১
ভাগ ঔষধ মেশানো হয়। ১০^৩০
মানে হলো ১ এর পেছনে ৩০টা শূন্য। কোটি, বিলিয়ন, ট্রিলিয়নের হিসেবও মার খেয়ে যাবে! বিজ্ঞানী এ্যাভোগ্রাডো বলেছিলেন যে ১ মোল পরিমাণ পদার্থে ৬.০২৩
X ১০^২৩ টি অণু,
পরমাণু বা আয়ন
থাকে (এটা রসায়নের মৌলিক একটি সূত্র)। ১ মোল মানে হলো, পদার্থের আণবিক বা
পারমানবিক ভরকে গ্রামে প্রকাশ করা। ১ মোল কার্বন মানে হলো ১২ গ্রাম কার্বন। ১২
গ্রাম কার্বনে ৬.০২৩ X ১০^২৩টি কার্বন অণু থাকে। এখন দেখা গেলো যে , ১০^৩০ পাওয়ারের হোমিওপ্যাথিক ঔষধে
মূল পদার্থের কোন অণুই অবশিষ্ট থাকে না।
দেখলেন তো লঘুকরণের জাদু! হ্যানিম্যানের সূত্রানুসারে, আপনি যত লঘু করবেন তত
পাওয়ার বাড়বে। পাওয়ার বাড়তে বাড়তে একদম নির্জলা পানিতে পরিণত হবে। তাতে কী, পানির
স্মৃতিতে সঞ্চিত আছে না ঔষধের গুণাবলী! সেই স্মৃতি দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে।
লজিক
হিসেবে কেমন মনে হচ্ছে আপনার কাছে?
আরো
কথা আছে! যে ঔষধগুলো আপনাকে বড়ি হিসেবে দেয়া হচ্ছে, সেখানে এই মেমরি অফ ওয়াটার
কীভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, আসুন দেখে নেই।
প্রথমে
পানির ভেতর ঔষধ দেয়া হলো। এরপর তা লঘু করা হলো। পানির স্মৃতি তৈরি হলো। এরপর তা
চিনির দলায় প্রবেশ করানো হলো। তারপর তা সেবন করলেন। তারপরে তা পরিপাক ক্রিয়ার
মাধ্যমে শরীরের ভেতরে গেলো। তারপরে তা শরীরের ভেতর মিশে গেলো।
এখন
বলেন, কোথায় ঔষধ, কোথায় পানি, আর কোথায় ঔষধের স্মৃতি!
আচ্ছা,
শরীরটাকে ঝাঁকানো লাগবে না? ঝাঁকালে নাকি বেশি কার্যকর হয়?
(২)
সব দোষ
“এ্যালোপ্যাথি’র
হোমিওপ্যাথির
পতন শুরু হয় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে। আবিষ্কৃত হয়
এন্টিবায়েটিক, জার্ম থিওরি, বিস্তৃত হয় পড়াশোনার ক্ষেত্র। হোমিওপ্যাথরা আটকে রইলো
সেই লঘুকরণ, আর পানির স্মৃতি থিওরিতেই। তারা ফিজিওলজি, এ্যানাটমি, প্যাথোলজি
নামমাত্র পড়েন, তাদের কাছে মেটিরিয়া মেডিকা, আর অর্গানন অফ মেডিসিনেই আছে সব
প্রশ্নের উত্তর। আধুনিক চিকিৎসাকে হোমিওপ্যাথরা মূলত তখন থেকেই এ্যালোপ্যাথি নামে
বলা শুরু করলো। হ্যানিম্যান অনেক আগেই এই শব্দটা বলে গেছেন, তবে তখন আধুনিক
চিকিৎসা বলে তেমন কিছুই ছিলো না। হোমিওপ্যাথিই তখন আধুনিক চিকিৎসা। আধুনিক চিকিৎসা
বিজ্ঞান নতুন নতুন সব গবেষণা, আর ঔষধে সমৃদ্ধ হতে লাগলো, একে একে ইউরোপের সব হোমিও
কলেজগুলি বন্ধ হয়ে যেতে থাকলো। তখন তার আবিষ্কার করলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব! “এ্যালোপ্যাথিক
ডাক্তার”রা নাকি ঔষধ কোম্পানির সাথে চুক্তি করে হোমিওপ্যাথিকে দাবিয়ে রাখতে শুরু
করেছে। যেহেতু হোমিও ঔষধের দাম কম, আর ‘এ্যালোপেথি’ ঔষধের দাম বেশি, তাই এতে
কোম্পানি এবং ডাক্তার, সবারই বেশি লাভ। এজন্যেই বেচারা হোমিওপ্যাথি উঠতে পারছে না!
আপনি
প্রত্যেক হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাছে একই বয়ান শুনবেন। আমি একাধিকবার শুনেছি। এই
কালকেই তো শুনলাম একজন পাস করা হোমিও ডাক্তারের কাছ থেকে! তিনি মার্কেট ইকোনমি
নামক একটি শব্দ ব্যবহার করলেন অতি আবেগের সাথে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, একটা প্রোডাক্টের
দাম নির্ধারিত হয় কনজিউমারের চাহিদার ভিত্তিতে। আপনারা ২৩০ বছরেও হোমিওপ্যাথির
যথার্থতা প্রমাণ করতে পারেন নি কেন? যদি চাহিদা তৈরি করতে পারতেন, যদি যথার্থতা
প্রমাণিত হত, যদি গোঁজামিল না দিতেন, তাহলে হোমিও ঔষধের দাম বেশি হতো, আর ‘এ্যালোপ্যাথি’র
দাম কম হত, ঠিক না?
হোমিওপ্যাথির
ব্যবসা নেই একদম, তা অবশ্য ঠিক না! ইউরোপের দেশগুলিতে গ্রহণযোগ্যতা কমছে দিনদিন,
কিন্তু ভারত, বাংলাদেশের মত দেশে বিস্তার লাভ করছে। কেন বিস্তার হচ্ছে, সে প্রশ্নে
পরে আসি। এখন আধুনিক বিশ্বে হোমিওপ্যাথির বর্তমান অবস্থাটা একটু দেখাই! যারা
হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাসী, তারা এগুলোকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে নিয়েন, আরে এক ড্রপ
বেলেডোনা খেয়ে নিয়েন। মানসিক অশান্তি দূর হবে।
ষড়যন্ত্র-১
ইউনাইটেড
কিংডমে National Health Service (NHS) ২০১৭ এর জুলাইয়ে এক রিপোর্ট
প্রকাশ করে। সেখানে হোমিওপ্যাথিকে অকার্যকর হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। রিপোর্টের
চুম্বক অংশ এখানে দিচ্ছি- “The
Australian NHMRC concluded that homeopathy should not be used to treat health
conditions that arechronic, serious, or could become serious. People who choose
homeopathy may put their health at risk if
they reject or delay
treatments for which there is good evidence for safety and effectiveness”
আরো- “The UK Science and Technology Committee report into
homeopathy in 2010 concluded that the systematic
reviews and meta-analyses
conclusively demonstrate that homeopathic products perform no better than
placebos.”
পুরোটা
পড়ুন এখান থেকে।
ষড়যন্ত্র
২
The Royal
London Hospital for Integrated Medicine ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে National
Health Service (NHS) এ
হোমিওপ্যাথি ঔষধের গবেষণার জন্যে ফান্ডিং বন্ধ করে দিয়েছে। লিংক- https://www.bbc.com/news/health-43373817
ষড়যন্ত্র
৩
অস্ট্রেলিয়ায়
প্রাইভেট হেলথ ইনসুরেন্সের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ১ এপ্রিল ২০১৯ তারিখ থেকে ইনসুরেন্স
কভারেজের আওতাও হোমিওপ্যাথি ট্রিটমেন্ট থাকছে না। তাদের ভাষায়- “From 1 April 2019 the following
natural therapies will be excluded from the definition of private
health insurance general
treatment and will no longer receive the private health insurance
rebate as part of a general
treatment policy: Alexander technique, aromatherapy, Bowen
therapy, Buteyko, Feldenkrais,
Western herbalism, HOMEOPATHY, iridology, kinesiology,
naturopathy, Pilates,
reflexology, Rolfing, shiatsu, tai chi, and yoga”
হোমিওপ্যাথি
নামটা ক্যাপিটাল লেটারে দিলাম, যেন দেখতে সুবিধা হয়।
কেন
তারা এটা করেছে?
“Why is this important?
A review chaired by the former
Commonwealth Chief Medical Officer found there is no clear evidence
demonstrating the efficacy of the excluded natural therapies.”
দেখলেন,
কমনওয়েলথের প্রাক্তন চিফ মেডিকেল অফিসারও ষড়যন্ত্র করে। কত্ত খারাপ!
লিংক- http://tinyurl.com/yxa2cym2
ষড়যন্ত্র
৪
আমেরিকার
Federal Trade Commission সাফ বলে দিয়েছে, হোমিওপ্যাথি ঔষধের গায়ে Unscientific এই লেবেল থাকতে হবে। বিস্তারিত- https://slate.com/technology/2016/11/the-ftcs-new-homeopathic-medicine-rules-will-backfire.html
আর কত
দেখতে চান? যত দেখতে চান, তত দেখাতে পারবো। ভালো হয়, নিজে একটু ঘেঁটে দেখলে।
(৪)
হোমিওপ্যাথদের
বিদ্যার দৌড়!
হোমিওপ্যাথরা
আসলে কী পড়ে? কতটা পড়ে? কতটা গভীরে যায়? চলেন একটু ইংল্যান্ডের একটা হোমিওপ্যাথিক
কলেজ থেকে ঘুরে আসা যাক। ইউকে’র “Centre for
Homeopathic Education (CHE)” তে আপনি চাইলে দুই বছরের একটি কোর্স করে লাইসেন্সপ্রাপ্ত
ডাক্তার হতে পারেন। প্রতি মাসে আপনার ক্লাস থাকবে সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ৬টি।
২০১৮ এর অক্টোবর থেকে ২০১৯ এর জুনের মধ্যে মোট ৪২টি ক্লাস করে আপনি ডাক্তার হয়ে
যাবেন! বাহ! মজা না?
ক্লাসের
সূচি এবং সিলেবাসের বিস্তারিত দেখুন এই লিংক থেকে-https://chehomeopathy.com/courses/full-time-practitioner/
বাংলাদেশে
অবশ্য আরো বেশি দিন পড়তে হয়।
“হোমিওপ্যাথি
বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অধিভুক্ত
একমাত্র সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক
বোর্ডের অধিভুক্ত অনুমোদিত কলেজগুলোতে। রয়েছে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স,
ইন্টার্নশিপসহ
ছয় বছর মেয়াদি ব্যাচেলর কোর্স এবং ডিপ্লোমা ডিগ্রিপ্রাপ্তদের জন্য পোস্ট ডিপ্লোমা
ট্রেনিং-ইন-হোমিওপ্যাথি”।
তো
তারা কী শিখছে সেখানে? এবার আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলবো!
(৫)
ছোটবেলায়
আমার মা বাসায় হোমিওপ্যাথি ঔষধ রাখতেন। আমি প্রতিদিন নিয়ম করে লুকিয়ে লুকিয়ে
মিষ্টি বড়িগুলো খেতাম। অতটুকু একটু শিশুর একটুও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, ওভারডোজ
কিছুই হলো না? আমার মধ্যে বড় হবার পর সন্দেহ জাগে, এবং আমি বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠি
পড়াশোনা করতে এ নিয়ে। সবখানেই খালি দেখি বিজ্ঞান দ্বারা এর যথার্থতার প্রমাণের
অভাব। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাই এই অপচিকিৎসার ফাঁকিবাজী সম্পর্কে। এখন আমার
কৌতূহল ছিলো, বাংলাদেশে এত বছর ধরে আসলে কী পড়ানো হয়? ৫ বছরের পড়াশোনা, চিকিৎসার
লাইসেন্স, খুব কম কথা নয়!
আগেই
উল্লেখ করেছি, ইতিমধ্যে আমার সাথে দুইজনের কথা হয়েছে, যাদের একজন হোমিওপ্যাথ,
আরেকজন মূলধারার চিকিৎসা থেকে হোমিওপ্যাথির দিকে সরে আসা একজন চিকিৎসক। তিনি ঐ
হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের প্রতিষ্ঠানের চিফ মেডিকেল এ্যাডভাইজার হিসেবে আছেন। তার সাথে
আমার কথোপকথন ছিলো এমন-(কিছুটা পরিমার্জিত)
-আপনি একজন
এমবিবিএস হয়ে কেন তাদের প্রতিষ্ঠানের চিফ মেডিকেল এ্যাডভাইজার? হোমিওপ্যাথে মূল
ধারা থেকে কেউ কেন এই পদে এলো না?
তার
উত্তর- তিনি অনেকদিন ধরে হোমিওপ্যাথি রিসার্চ করছেন, স্টাডি করছেন, ফলে তার
অভিজ্ঞতা হয়েছে। আর তাছাড়া বিভিন্ন রিপোর্ট আসে যেগুলি তিনি পড়েন, এছাড়া ‘এ্যালোপ্যাথি’ ঔষধ চললে তো হঠাৎ করে
প্রত্যাহার করে নেয়া যায় না, এসব কাজে তিনি তাদের সাহায্য করেন।
অর্থাৎ,
দেখুন, একটা রিপোর্ট পড়ে এতে কী আছে বোঝার বিদ্যা এই হোমিওপ্যাথদের নেই। তার জন্যে
একজন “এ্যালোপ্যাথ” রাখতে হয়েছে। তিনি আবার হোমিওপ্যাথদের ফিজিওলজি এবং এনাটমির
কোর্সও করান!
-আচ্ছা,
আপনি ফিজিওলজি এবং এনাটমির শর্টকোর্স করান হোমিওপ্যাথদের, তার মানে কি, তারা এসব
জানে না? আর যেহেতু কোর্স করান, তার মানে তাদের এইসব জানার প্রয়োজন আছে বলে আপনি
উপলব্ধি করেছেন?
তার
উত্তর- হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে আসলে অতকিছু শেখায় না, সরকারের সদিচ্ছার অভাব,
বাজেট কম ইত্যাদি!
-সরকার তো বাজেট দিয়েছে! হোমিওপ্যাথির কলেজ স্থাপিত করে দিয়েছে। এখন সিলেবাসটাও কি সরকার করে দিবে? যারা হোমিওপ্যাথির শিক্ষক, তারা জানে না এসব?
-সরকার তো বাজেট দিয়েছে! হোমিওপ্যাথির কলেজ স্থাপিত করে দিয়েছে। এখন সিলেবাসটাও কি সরকার করে দিবে? যারা হোমিওপ্যাথির শিক্ষক, তারা জানে না এসব?
উত্তর
নেই।
এই
চিকিৎসক আবার নতুন এক থিওরির কথা বললেন। টটোপ্যাথি (Tautopathy), এখানে এ্যালোপেথি ঔষধকে হোমিওপ্যাথিক পদ্ধতিতে লঘু করে
দেয়া হয়। মানে, আপনি একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট না খেয়ে এর ক্ষুদ্র এক কণাকে
পানির সাথে মিশিয়ে, আরো পানির সাথে মিশিয়ে, ঝাঁকিয়ে তারপর খাবেন।
কেমন
মনে হচ্ছে সিস্টেমটা?
সেদিন
সেই আলাপে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বলেছিলেন যে ‘এ্যালোপ্যাথি’তে কিছু হলেই টেস্ট করতে
দেয়া হয় একগাদা, যন্ত্রের নিচে নিয়ে যাওয়া হয়, হোমিওপ্যাথি হচ্ছে প্রাকৃতিক,
ইত্যাদি।
তা
জনাব, সার্জারি করতে তো সেই যন্ত্রপাতিরই দ্বারস্থ হতে হয়। আপনাদের মেটিরিয়া মেডিকা অথবা অর্গানন অফ মেডিসিনে
সার্জারির বিদ্যা দেয় নি। কনভার্টেড
হোমিওপ্যাথ এটাকে সামাল দিলেন এভাবে- প্রচলিত পদ্ধতিতে সার্জারি করা হবে, এবং
সার্জারির পর ঔষধ দেয়া হবে হোমিওপ্যাথিক। এই হলো গিয়ে হোমিওপ্যাথিক সার্জারি!
হোমিওপ্যাথরা
আসলে কী শেখে এ নিয়ে আমার শেখার আরো বাকি ছিলো।
এজন্যে আমি চলে গেলাম আমার বাসার কাছের হোমিওপ্যাথি স্টোরে। সেই ভদ্রলোক
ফার্মগেটের এক হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা পাস করেছেন ২০১৪ সালে। ইনি
কিন্তু সায়েন্সের ছিলেন না, আর্টসের! দারুণ না? সরকারিতে অবশ্য আপনাকে সায়েন্স
থাকতে হবে, তবে বাংলাদেশে যে ৬১টি বেসরকারী হোমিও কলেজ আছে, সেখানে আপনি
ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও পড়তে পারবেন। অর্থাৎ আপনাকে বায়োলজি শেখানে নতুন করে
শিখতে হবে। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কী পড়েন আপনারা সেখানে? তার উত্তর-
মেটিরিয়া মেডিকা, অর্গানন, ফিজিওলজি, এ্যানাটমি, দর্শন (জ্বী ঠিকই পড়ছেন, দর্শন),
ইত্যাদি। তিনি বারবার বলতে লাগলেন, হোমিওপ্যাথি অনেক শক্ত পড়া, প্রচুর পড়তে হয়,
সারাজীবন পড়তে হয়। আমি বেশ প্রীত হলাম শুনে। তার ডেস্কে বেশ কিছু বই দেখতে পেলাম।
সব লক্ষণ বিচার এবং ঔষধ সংক্রান্ত বই। আমার জানতে ইচ্ছে হলো, এ্যানাটমি, ফিজিওলজি
কতটুকু পড়ায়। তিনি জানালেন যে এ্যানাটমি,ফিজিওলজি তার আসলে মনে নেই সেভাবে। অনেক
আগের পড়া তো! সেই ২০১৪ সালে বের হয়েছেন পাস করে, এতদিন এ্যানাটমি, ফিজিওলজি কীভাবে
মনে থাকে, বলেন? যৌক্তিক কথাই বটে। তিনি ঐ বইগুলি দিয়ে দিয়েছেন কাকে যেন। রেখে
দিয়েছেন শুধু মহাগ্রন্থ মেটিরিয়া মেডিকা আর অর্গানন অফ মেডিসিন।
তার
চেম্বারে লেখা ছিলো তিনি “বেস্ট ক্যান্সার” এর চিকিৎসা করেন। তাকে আমি জিজ্ঞাসা
করলাম,
-আপনি
ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা করেন?
-না!!!
(সজোরে মাথা নাড়িয়ে)
-তাহলে
লেখা আছে যে?
-কোথায়
লেখা আছে?
-আপনার
চেম্বারের সাইনবোর্ডে!
তখন
তার মনে পড়লো যে তিনি একবার “বেস্ট ক্যান্সার” এর চিকিৎসা করেছিলেন। রোগী অত্যন্ত
দরিদ্র ছিলেন, ডাক্তার বলেছিলেন ব্রেস্ট কেটে ফেলতে হবে, ৩ লাখ টাকা লাগবে এজন্যে,
গরীব মানুষ, এত টাকা পাবে কই! সেজন্যে হোমিও চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। তা তিনি নাকি
চিকিৎসা দিয়েছেলন, এবং ৪ মাসের মধ্যে রোগী ভালো হয়ে গেছেন!
এরপর
আমার প্রশ্ন,
-তাহলে
আমি যদি আপনার কাছে ব্রেস্ট কেটে ফেলতে হবে এমন রোগী নিয়ে আসি, আপনি চিকিৎসা
করবেন?
-না!।
-কেন?
-আসলে
শেষ পর্যায়ে আমাদের কাছে আসলে কিছু করার থাকে না।
-কিন্তু
একজন তো শেষ পর্যায়ে আপনার কাছে এসেছিলো, ভালোও হয়েছে!
-ওহ
আচ্ছা! ওটা তো...
এরপর
তিনি আধ্যাত্মিক লেভেলের কথাবার্তায় চলে গেলেন। আমি আর কথা বাড়ালাম না। তাকে
জিজ্ঞেস করলাম, আমার এক ভাইয়ের কিডনি ডায়ালিসিস চলছে, তাকে তার কাছে আনতে পারি কি
না। তিনি সে চিকিৎসাও করবেন না। সবাই খালি তাদের কাছে শেষ পর্যায়ে আসে, তখন তাদের
কিছুই করার থাকে না।
তারা
আসলে করেটা কী! এই জ্বর, ঘামাচি, হেঁচকি, গলার কাঁটা, এসব সারায়। যেগুলোর কিছু
কিছু প্লাসিবো, কিছু কিছু শরীরের স্বাভাবিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতায় সারে, আর কিছু
কিছু...
স্টেরয়েড
দিয়ে তাৎক্ষণিক উপশম দেয়া হয়!
জ্বী,
স্টেরয়েড আপনার ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ইত্যাদি তাৎক্ষণিকভাবে উপশম করতে পারে, তবে দীর্ঘদিন
প্রয়োগে এর ফলাফল মারাত্মক!
(৬)
এখন
আপনি প্রমাণ দেখাবেন যে আপনার অমুক তমুক, এই সেই, ইত্যাদি কীভাবে হোমিওপ্যাথি করে
ভালো হয়েছ, তাই না? আপনি ১০টা প্রমাণ দেখাতে পারলে আমি ১০০০টা দেখাবো, যে
হোমিওপ্যাথি কোন কাজ করে নি। আমি আমার পরিচিত ৭-৮ জন ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।
তারা সবাই হোমিওপ্যাথি নিয়ে মহাবিরক্ত!
একজন
তরুণ ডাক্তার বললেন- “হোমিওপ্যাথি নিয়ে কতটুকু বলতে পারবো জানি না। তবে অভিজ্ঞতা
আছে অনেক। জন্ডিসের প্রায় সব রোগীই এই কান্ড করে। আগে হোমিওপ্যাথি করে। তারপর
উন্নতি হয়না। অর আরো খারাপ হয়। তারপর হাসপাতালে আসে। সবচেয়ে খারাপ হয় হেপাটাইটিস
বি রিলেটেড ক্রোনিক লিভার ডিজিজে। এরা হোমিওপ্যাথি খায়। লিভারের আরো বারোটা বাজে। এনকেফালোপ্যাথি
হয়। তারপর হাসপাতালে আসেন”।
আরেকজন
অভিজ্ঞ ডাক্তার জানালেন, স্বয়ং হোমিওপ্যাথ ডাক্তাররাই তাদের বাচ্চার চিকিৎসা নিতে
তার কাছে আসে।
গুলজার
ভাই তো এটা নিয়ে একটা সিরিজই লিখে ফেলেছেন- https://www.facebook.com/gulzar.h.ujjal/posts/10210920386459580
তো, কী
বলবেন, তারা সব ঔষধ কোম্পানির সাথে আঁতাত করে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত?
লেখার
শুরুতে বলেছি, এখনও বলছি, আমি খোলামন নিয়ে অপেক্ষায় আছি। শক্ত প্রমাণ দেখান, আমি
হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস আনবো।
গতকাল
হোমিও চেম্বার থেকে বেরুনোর সময় ঘুমের সমস্যার কথা বলে মিষ্টি ঔষধ খেয়ে এসেছি
দুখানি। ডাক্তার সাহেব ভিজিট নেন নি। আমি তার চিকিৎসা দক্ষতায় মোহিত না হলেও
মহত্বে আপ্লুত!
onekdin dhorei vabsilam aguli
ReplyDeleteগাঁজার দাম কি কমে গেছে, নাকি কোন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের কাছে........ খাইছেন।
ReplyDelete