অদৃষ্টবাদী অন্ধকারে
বিকাল পাঁচটায় সূর্যের বিদায়পর্ব শুরু হলে কিছু মানুষ ফুটপাথের ধারে সাপের খেলা দেখতে মজে যায়। বেদেনী সাপুড়ের শরীরের বাঁকে সূর্য বিষণ্ণ আলো ফেলে তাকে চক্ষুমৈথুন থেকে রক্ষা করতে চায়। সাপের খেলা জমে ওঠে ধীরে ধীরে। বিষধর সাপেরা বেদেনীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে নিজেদের ফণার নৈপুন্যময় নৃত্য এবং বিষদাঁতের ভয়াল প্রদর্শনীতে মেতে ওঠে। মানুষগুলোর চোখ শঙ্কামিশ্রিত কৌতূহলে বেদেনীর শরীর থেকে সর্পনৃত্যে ধাবিত হয়। কুটকুট করে বিস্কুট খাওয়া একজন বালক মজা পেয়ে হাসে। বয়স্ক বহুমূত্র রোগীদের পেচ্ছাপের বেগ পায়। আর সর্পদিগের মালিকান উদাস চোখে সূর্যের চলে যাওয়া দেখে। ব্যাপারটা এমন না যে, সে কখনও সূর্যের চলে যাওয়া দেখেনি। তারপরেও সে নিবিড়ভাবে সূর্যের প্রস্থানপর্ব পুরোটা দেখবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তার মধ্যে বেদনাবোধ জাগে। তপ্ত শহরে দিনময় ঘুরে ফিরে সর্পকলা ফেরী করার সময় সে ঘর্মাক্ত এবং পরিশ্রান্ত হয়ে সূর্যকে শাপশাপান্ত করলেও তার সাপেরা প্রবোধ দিয়েছিলো তখন। সাপেদের ভাষা সে বুঝতে পারে। এবং এও জানে যে ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের চেয়ে সাপেরা বেশি বিবেচনাবোধের পরিচয় দেয়। তাই মেয়েটি তর্ক করেনি ওদের সাথে। এখন সে বুঝতে পারে, তার ষষ্ঠইন্দ্রিয়ের প্রখরতা এবং চন্দ্রবোড়া, শঙ্খচূড়ের চোখের খরতা তাকে বুঝিয়ে দেয়, সূর্য প্রস্থান করছে অনির্দৃষ্টকালের জন্যে। অমাবস্যা নামবে শহরে। অমানিশার অনাস্বাদিত ব্যঞ্জনে তুষ্ট হয়ে ব্যাঞ্জো বাজাবে বাজিয়েরা। আর সে, তার সব সাপ ছেড়ে দেবে। অমাবশ্যাকালীন সময়ে বেদেনী হবে রাণী, সর্পকুল হবে অনুগত সেনাদল। ক্ষমতার লোভ তাকে আগ্রাসী না করে বরঙ বিষণ্ণ করে তোলে, একবার ভাবে, "দেবো নাকি সাপগুলোকে ফের ঝাঁপিতে ঢুকিয়ে?"। কিন্তু তার ঝাঁপি থেকে আরো সাপ বের হয়, হতেই থাকে। নির্বিষ ঢোড়া সাপ থেকে বিষাক্ত শঙ্খিনী, গোখরো। বেদেনীর মধ্যে এসব দেখে ক্ষমতার শিহরণ ঢুকে যায় দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সমবেত জনতা ভয় পায়। তারা তাকে সাপগুলো ভেতরে ঢোকানোর জন্যে অনুরোধ করে। সে নির্বিকারভাবে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে।
সন্ধ্যা নেমে আসে গুপ্তঘাতকের মত নিপুণ চাতুরতায়। সবাই জেনে যায় এক হতচ্ছাড়া বেদেনী সর্পসন্ত্রাসের মাধ্যমে নগরবাসীকে ভীত করার চেষ্টা করছে। প্রতিরোধের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয় মানুষেরা। মানুষ বাড়ার সাথে সাথে সাপের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, আর কমতে থাকে আলো। সূর্যের অভিমানী প্রস্থানকে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ক্রিয়া ভেবে কেউ ওটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। ঘটনাস্থলে একের পর এক ভীতি উদ্রেককারী অলৌকিক ঘটনা ঘটতে থাকলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আঁধারের জলে প্লাবিত শহরটার আর্দ্র স্পর্শ অনুভব করে বিচলিত হয়। জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী একজন গরমিলটা ধরতে পারে। আজ পঞ্জিকার হিসেব অনুযায়ী পূর্ণচাঁদ থাকার কথা। মেঘ নেই, সূর্য চলে গেছে সেই কখন! এখনও ধার করা আলো নিয়ে ছাদের মানুষদের বিলাস উপকরণ হয়ে চাঁদ নামলো না! এসব চিন্তাভাবনা ছিলো বিক্ষিপ্ত। সবার মনোযোগের কেন্দ্রে সর্প অভ্যুত্থান, এবং বেদেনী মেয়েটির সর্পমানবীতে পরিণত হওয়া।
মেয়েটি হঠাৎ করেই সর্পমানবী হয়ে যাচ্ছে, এই অলৌকিক দৃশ্য সবার মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বিশ্বাসীরা জয়োল্লাস করে, অবিশ্বাসীরা বিড়বিড় করে কী বলে বোঝা যায় না। সাপেরা ছড়িয়ে পরছে শহরের সবখানে। সদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক বৈরিতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বৈদ্যুতিক বাতিগুলোও বিকল হয়ে গেছে। অন্ধকারে সাপেদের গা মাড়িয়ে দিলে তারা হিসহিসিয়ে ফণা তুলে ভয় দেখায়। তবে দংশন করে না। মানুষেরা দৌড়ে পালায়। পড়ে থাকে তাদের স্যান্ডেল, লুঙ্গি, পেটিকোট।
শুধু একটা ন্যাংটো ছেলে কুড়মুড় করে বিস্কুট খায় আর হাসে। চলে যাবার সময় ফেলে রাখে বিস্কুটের প্যাকেট।
শুধু একটা ন্যাংটো ছেলে কুড়মুড় করে বিস্কুট খায় আর হাসে। চলে যাবার সময় ফেলে রাখে বিস্কুটের প্যাকেট।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের ওপর নির্দেশ বর্তায় সর্পসন্ত্রাস সম্পর্কিত প্রতিবেদন তৈরি করতে। তবে বেদেনী মেয়ের সর্পমানবীতে রূপান্তরিত হবার কথা জেনে নির্দেশ পাল্টে দ্বিতীয় খবরটিকে অগ্রাধিকার দেবার কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়। সৌভাগ্যবান কিছু সাংবাদিক কর্মতৎপরতার স্বাক্ষর রেখে মানবী থেকে সর্পমানবীতে পরিণত হবার অভূতপূর্ব প্রক্রিয়া দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলেও আলোর অভাবে ছবি তুলতে পারে নি।
আলো কমে আসছে...
অলস, নার্ভাস এবং কর্মবিমুখ সাংবাদিকেরা যখন বিলম্বে অকুস্থলে উপস্থিত হল, তখন তারা বিরক্তির সাথে লক্ষ্য করল যে, সেখানে কোন সর্পমানবী নেই। বড় একটা অজগর কুণ্ডলী পাঁকিয়ে শুয়ে আছে। তাদের উষ্মা খেয়াল করে সমবেত জনতা সাগ্রহে জানাল যে, সর্পমানবী কিছুক্ষণ আগে সর্পে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং তার ছোট্ট ঝাঁপি থেকে অজস্র সাপ বেরিয়ে এসে শহরের সবখানে ভীতি সঞ্চার করে চলেছে। এই তথ্য পাবার পরে সাংবাদিকেরা অজগরটির সাক্ষাৎকার নিতে ঘিরে ধরে, কেউ কেউ উপদ্রুত অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করতে ছোটে। ধর্মভীরু কিছু মানুষ এই আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতেও পরিতুষ্ট হয়। কারণ অনেকদিন ধরে অলৌকিক কিছু ঘটছিলো না বলে ধর্মের কলকব্জাগুলো অবিশ্বাসীরা কব্জা করে খুলে নিয়ে যাচ্ছিলো। এবার দেখলে তো! নিজের চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছো মানবী থেকে সর্পমানবী, সর্পমানবী থেকে সর্প। ঝাঁপি থেকে অগুনতি সাপ, মেঘমুক্ত আকাশেও পূর্ণিমা তিথিতে গরহাজির চাঁদ, অকাল অমাবস্যা। এখানে একটা মাজার স্থাপন করা উচিত, ভক্তিভরে ভাবে তারা। একই কথা বিশ্বাস ব্যবসায়ীরাও ভাবে, তবে অন্যভাবে- জমবে ভালো! অবিশ্বাসীরা এই অভাবনীয় অপ্রাকৃত ঘটনার তত্ত্বতালাশে মশগুল হলে বিরাটকায় অজগর সাপটি তেড়ে আসে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সবার দিকেই, বর্ণশিক্ষার বইয়ের প্রথম অক্ষর দ্বারা তৈরি বাক্যটির মত। তেড়ে আসা বলাটা হয়তো ঠিক হবে না, সে হয়তো তার স্বাভাবিক গতিতেই এগুচ্ছিলো, তবে প্রাচীন বর্ণাদিষ্ট বর্ণান্ধরা ভক্তির রঙ খুঁজে না পেয়ে এবার ভয়ের রঙ দেখে। তারা পালায়। সবার গতিরোধ করে সাবেক সর্পকন্যা অজগরটির অনুসারী সাপেদের দল। বেষ্টনী তৈরি করে আবদ্ধ করে রাখে। অন্ধকার শহরে তাদের দেহের বর্ণিল অলঙ্করণই যা একটু দ্যুতি দেয়। এই আলোকে অবলম্বন করে বাঁচতে চায় কিছু মানুষ। সর্পাবদ্ধ হয়েও, পরিস্থিতি দুর্বোধ্য হলেও এই আলোটুকু নতুন পথের সন্ধান দেবে বলে তারা মনে করে।
আর এসব দেখে একটা দুষ্টু বালক বিস্কুট খেতে খেতে মজা পেয়ে হাসে।
-কী রে! খুব মজা পেয়ে গেছিস, না? মানুষকে ভয় দেখিয়ে খুব আনন্দ তোদের?
অজগরটিকে উদ্দেশ্য করে বলে সে। অন্যান্য সাপেদের জমায়েত জনতাকে পাহাড়ায় রেখে বালক এবং অজগর আরো মজা দেখতে বেরোয়।
-তা তোকে তো সর্পমানবী হিসেবেই ভালো দেখাচ্ছিলো বেশ, এরকম বেঢপ আকারের অজগর হয়ে গেলি কেন বেমক্কা?
সাপেরা কথা বলতে পারে না। তবে তার প্রাক্তন মানবজন্ম থেকে উৎসারিত জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারে ঠিকই। দুষ্টু বালক এতক্ষণ ব্যাপারটাতে বেশ মজা পেলেও তার বিস্কুট শেষ হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হয়।
-দ্যাখ কী করেছিস! তোদের ভয়ে তো সবাই দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে এখন আমি বিস্কুট কোথায় পাবো?
কেঁদে ফেলে বালক। বালকটির সহচর ভূমিকা এবং দুষ্টু হাসি অজগরটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো। তার প্রাপ্ত অলৌকিকতাকে যথাযথ সম্মান দেখাচ্ছে কী না ভাবছিলো। শেষতক সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে বালকটি এসবের থোরাই কেয়ার করে। অজগর ক্ষেপে ওঠে। তার ক্ষিধেও পায়। ক্রন্দনরত বালকটির অর্ধাংশ গিলে ফেলে। এসময় অন্যান্য সাপেরা তাদের প্রভুকে উৎসাহ দেবার জন্যে ছুটে আসে। শুধুমাত্র একটি সাপ এহেন আচরণের বিরোধীতা করে। হিসহিসিয়ে সর্পভাষায় বলে, শুধুমাত্র ভয় দেখানোটাই নীতিপুস্তকে ছিলো। কাউকে ছোবল মারা বা মেরে ফেলার কথা ছিলো না। সে এও বলে যে, প্রাক্তন মানবজন্মের সঞ্চিত পাপই তাকে এহেন রীতিবিরুদ্ধ কাজ করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। সূর্যের তিরোধান, আকস্মিক অমাবস্যা এবং বৈদ্যুতিক গোলযোগের ফলে সৃষ্ট সুযোগের যথাযথ ব্যবহার না করতে পারলে সর্পসমাজের জন্যে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপর্যয়। কিন্তু অজগরটির তখন নতুন স্বাদের খাবার পেয়ে ঘোরগ্রস্থ অবস্থা। সে ধীরেসুস্থে খাদ্য উপভোগ করে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তার বক্তব্য শোনার জন্যে। সে ধীরেসুস্থে খাদ্যপ্রক্রিয়া সমাপ্ত করার পরে ছোট্ট করে বলে "প্রয়োজনে মহাপুস্তকে বর্ণিত নীতিমালা পরিবর্তন করা যেতে পারে।" সবাই তা মেনে নিয়ে সোল্লাসে নতুন আইন কার্যকর করার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অন্ধকার শহরে সাপেরা ঘুরে বেড়ায়। এবার তারা অনেক হিংস্র এবং জিঘাংসু। তারা দংশনের সনদ ফণায় ঝুলোয়। অন্ধকারে মানুষ অবশ্য এতকিছু দেখতে পায় না স্পষ্টভাবে, তবে অন্ধকারের বিষণ্ণ মানুষেরা, যারা স্বেচ্ছায় গেছে নির্বাসনে, ঠিকই দেখতে পায়। তারা সদাবিষণ্ণ। সূর্যের চলে যাওয়ায়, সাপেদের আগমনে তারা বিষণ্ণ হয়। নতুন রঙের অন্ধকার তদের বিষণ্ণ করে তোলে। তাদের একজনের পাশে গুটিগুটি পায়ে ঘেঁষে দাঁড়ায় একটি বালক। বালকেরা সবার কাছেই যায় প্রফুল্ল কৌতূহলে। সাপ, অন্ধকার অথবা বিষণ্ণ মানুষ, সবার কাছে।
-এসেছো? এই নাও তোমার জন্যে বিস্কুট রেখে দিয়েছি। বালকটি কুটকুট করে বিস্কুট খায়, আর হাসে। বালকদের বিস্কুটের প্যাকেট সাপেদের চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটায়। তাদের দিকে ফণা তুলে এগিয়ে আসে বিষধর সাপেদের দল। সর্প দংশনে অনেক বালক মারা যায়। আর যারা বেঁচে থাকে, তারা হাসে। বিষণ্ণ মানুষেরা আরো বিষণ্ণ হয়। শহরের এমন নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতেও বের হয় স্রেফ বিস্কুটের প্যাকেটগুলো কুড়িয়ে নিতে।
-কী রে! খুব মজা পেয়ে গেছিস, না? মানুষকে ভয় দেখিয়ে খুব আনন্দ তোদের?
অজগরটিকে উদ্দেশ্য করে বলে সে। অন্যান্য সাপেদের জমায়েত জনতাকে পাহাড়ায় রেখে বালক এবং অজগর আরো মজা দেখতে বেরোয়।
-তা তোকে তো সর্পমানবী হিসেবেই ভালো দেখাচ্ছিলো বেশ, এরকম বেঢপ আকারের অজগর হয়ে গেলি কেন বেমক্কা?
সাপেরা কথা বলতে পারে না। তবে তার প্রাক্তন মানবজন্ম থেকে উৎসারিত জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারে ঠিকই। দুষ্টু বালক এতক্ষণ ব্যাপারটাতে বেশ মজা পেলেও তার বিস্কুট শেষ হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হয়।
-দ্যাখ কী করেছিস! তোদের ভয়ে তো সবাই দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে এখন আমি বিস্কুট কোথায় পাবো?
কেঁদে ফেলে বালক। বালকটির সহচর ভূমিকা এবং দুষ্টু হাসি অজগরটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলো। তার প্রাপ্ত অলৌকিকতাকে যথাযথ সম্মান দেখাচ্ছে কী না ভাবছিলো। শেষতক সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে বালকটি এসবের থোরাই কেয়ার করে। অজগর ক্ষেপে ওঠে। তার ক্ষিধেও পায়। ক্রন্দনরত বালকটির অর্ধাংশ গিলে ফেলে। এসময় অন্যান্য সাপেরা তাদের প্রভুকে উৎসাহ দেবার জন্যে ছুটে আসে। শুধুমাত্র একটি সাপ এহেন আচরণের বিরোধীতা করে। হিসহিসিয়ে সর্পভাষায় বলে, শুধুমাত্র ভয় দেখানোটাই নীতিপুস্তকে ছিলো। কাউকে ছোবল মারা বা মেরে ফেলার কথা ছিলো না। সে এও বলে যে, প্রাক্তন মানবজন্মের সঞ্চিত পাপই তাকে এহেন রীতিবিরুদ্ধ কাজ করতে উৎসাহ যুগিয়েছে। সূর্যের তিরোধান, আকস্মিক অমাবস্যা এবং বৈদ্যুতিক গোলযোগের ফলে সৃষ্ট সুযোগের যথাযথ ব্যবহার না করতে পারলে সর্পসমাজের জন্যে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ বিপর্যয়। কিন্তু অজগরটির তখন নতুন স্বাদের খাবার পেয়ে ঘোরগ্রস্থ অবস্থা। সে ধীরেসুস্থে খাদ্য উপভোগ করে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে তার বক্তব্য শোনার জন্যে। সে ধীরেসুস্থে খাদ্যপ্রক্রিয়া সমাপ্ত করার পরে ছোট্ট করে বলে "প্রয়োজনে মহাপুস্তকে বর্ণিত নীতিমালা পরিবর্তন করা যেতে পারে।" সবাই তা মেনে নিয়ে সোল্লাসে নতুন আইন কার্যকর করার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। অন্ধকার শহরে সাপেরা ঘুরে বেড়ায়। এবার তারা অনেক হিংস্র এবং জিঘাংসু। তারা দংশনের সনদ ফণায় ঝুলোয়। অন্ধকারে মানুষ অবশ্য এতকিছু দেখতে পায় না স্পষ্টভাবে, তবে অন্ধকারের বিষণ্ণ মানুষেরা, যারা স্বেচ্ছায় গেছে নির্বাসনে, ঠিকই দেখতে পায়। তারা সদাবিষণ্ণ। সূর্যের চলে যাওয়ায়, সাপেদের আগমনে তারা বিষণ্ণ হয়। নতুন রঙের অন্ধকার তদের বিষণ্ণ করে তোলে। তাদের একজনের পাশে গুটিগুটি পায়ে ঘেঁষে দাঁড়ায় একটি বালক। বালকেরা সবার কাছেই যায় প্রফুল্ল কৌতূহলে। সাপ, অন্ধকার অথবা বিষণ্ণ মানুষ, সবার কাছে।
-এসেছো? এই নাও তোমার জন্যে বিস্কুট রেখে দিয়েছি। বালকটি কুটকুট করে বিস্কুট খায়, আর হাসে। বালকদের বিস্কুটের প্যাকেট সাপেদের চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটায়। তাদের দিকে ফণা তুলে এগিয়ে আসে বিষধর সাপেদের দল। সর্প দংশনে অনেক বালক মারা যায়। আর যারা বেঁচে থাকে, তারা হাসে। বিষণ্ণ মানুষেরা আরো বিষণ্ণ হয়। শহরের এমন নৈরাজ্যময় পরিস্থিতিতেও বের হয় স্রেফ বিস্কুটের প্যাকেটগুলো কুড়িয়ে নিতে।
বালকটিকে গলাধঃকরণ করার পরে অজগর সাপটির তন্দ্রা পায়। তবে ঘুমের বদলে এই অলৌকিক ঘটনা পরম্পরাকে বিশ্লেষণ করতেই তার আগ্রহ জাগে। কিন্তু সে আবিষ্কার করে যে তার চিন্তাশক্তি নেই আর মনুষ্যজন্মের মত। সে আদতেই একটি অজগর সাপ এখন। এজন্যে অবশ্য তার আফসোস হয় না মোটেও। সে ঘুমিয়ে পড়ে। সে মুহূর্তে আরেকজন বিস্কুটখেকো দুষ্টু বালকের হাসিতে তার নিদ্রাভঙ্গ ঘটলে অনুগত সর্পদল এবং কিছু মানুষ যৌথ প্রযোজনায় বালকটির মৃত্যু ঘটায় অনবরত ছোবল এবং আঘাতে।
বালকের হাত থেকে পড়ে যায় বিস্কুটের প্যাকেট।
এই অমাবশ্যাকাল এবং সর্পরাজত্ব কেবলই দীর্ঘায়িত হতে থাকে।কমতে থাকে হাস্যোজ্জ্বল বালকদের সংখ্যা। বাড়তে থাকে বিষণ্ণ মানুষ। বাড়তে থাকে বিপন্ন মানুষ। তবে বিপন্নতার মধ্যেও সুখ খুঁজে পায় অনেকেই, অনেক অনেক দিন পরে অলৌকিক কিছু ঘটেছে বলে, এবং আরো ঘটবে, এই আশায়। সাপেদের প্রতি অবনত হয়ে তারা মন্দির এবং মাজার নির্মাণ করে। বালকেরা বড় হতে থাকে। তাদের কেউ সর্পধর্মবিশারদ হয়ে ওঠে, কেউ কেউ সূর্যের খোঁজে শহর ত্যাগ করে। তাদের বিস্কুটের প্যাকেট কেড়ে নেয়া হয় সাপেদের প্রসাদ হিসেবে। আর সূর্যটা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে গিয়ে অভিমান ভরে ভাবে আবার ফিরে যাবে কী না সেখানে। ফিরে যাবার জন্যে ছটফট করে সে। কিন্তু তাকে যে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে! সে ভাবেনি তার সাময়িক অভিমানের জন্যে চিরস্থায়ীভাবে নির্বাসিত হতে হবে। সূর্যটা জানে তার জন্যে মানুষের অনেক ধকল পোহাতে হয়। রোদ, খরা- কিন্তু এসবের জন্যে তো সে দায়ী না! পৃথিবীর ঘূর্ণনের ওপর তার তো কোন নিয়ন্ত্রণ নেই! তবু কেন তারা বলে কথিত মহাপ্রলয়ের দিন সে নীচে নেমে এসে মানুষের দশ হাত ওপর থেকে মগজ সেদ্ধ করার অভিপ্রায় নিয়ে বসে আছে!
অন্ধকার, শীতল, প্রাণহীন শহরে মানুষেরা মারা যেতে থাকে, সাপেরাও। শুধু পড়ে থাকে বালকের ফেলে দেয়া, অথবা তাদের কাছ থেকে কেরে নেয়া বিস্কুটের প্যাকেট। অদৃষ্টবাদী না বলেই জড় বস্তুরা টিকে থাকে এই শীতল সর্পশহরে। অবশ্য তাদেরকে জড়বস্তু বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না, ওখানে যে মিশে আছে বিষণ্ণ মানুষের কোমল উপহার, বালকের অপাপবিদ্ধ হাসি, আসন্ন মৃত্যুর বিরুদ্ধে যুঝবার সাহস...
Comments
Post a Comment