তাবিজের বীজ

ছোটবেলায় রাসেল ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠতো এবং বিছানা ভেজাতো। তার মা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। জীবনের চলার পথে হোঁচট খেলে বা যেকোন রকম বেকায়দায় পড়লে ধর্মগুরুদের শরণাপন্ন হয়ে তাবিজ-কবচ-সুরামিশ্রিত পানি ইত্যাদি সংগ্রহ করে অভয় খোঁজাটা ছিলো তার নিত্যদিনের অভ্যাস। তার স্বামী-সন্তান থেকে শুরু করে খোঁয়াড়ের গরু-ছাগল, এমন কী বাসার আসবাবপত্রগুলোও তার এহেন আচরণের ভুক্তভোগী অথবা সেবা গ্রহণ করে ধন্য হতো! রাসেলের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। প্রথমদিকে তার মা তেমন একটা গুরুত্ব দেন নি। তবে ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময়ও যখন এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া গেলো না তখন তিনি গ্রামের দশ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে অবস্থিত সেই সময়ের সবচেয়ে নামজাদা পীরের কাছে গেলেন ছেলেকে নিয়ে। শহরে যেমন প্রসিদ্ধ ডাক্তারদের সিরিয়াল পাওয়া মুশকিল, সেই সময়ের গ্রামে একই ব্যাপার ঘটতো পীরদের ব্যাপারে। বিশালদেহী পীরজাদা আটরশিয়ে ওয়া রাজারবাগ সাল্লাম তাকে দেখে হুংকার দিয়ে উঠলেন, "কী সমস্যা তোর বল!"। তিনি কাঁদোকাঁদোভাবে বিছানা ভেজানো এবং ভয় পাওয়ার ইতিবৃত্ত বয়ান করলে হুজুর শুনে যারপরনাই গম্ভীর হয়ে মেঘগুরগুর কণ্ঠে তার খাদেমদের নির্দেশ দিলেন বালকটির কোমড়ে একটি "স্পেশাল" দোয়াসম্বলিত তাবিজ বেঁধে দিতে। পীরের খাদেমবর্গ রাসেলের মায়ের ভাগ্যের প্রশংসা করে। এই স্পেশাল তাবিজ দিয়ে নাকি তজবীর কাজও করা যাবে। অর্থাৎ ইহকালের বিপদ থেকে যেমন মুক্তি দিবে, তেমন পরকালের জন্যে "নেকি স্কোর" বাড়ানোর জন্যে এটার গিঁটে গিঁটে হাত দিয়ে জিকিরও করা যাবে। টুইনওয়ান আর কী! ছেলেকে তাবিজবন্ধ অবস্থায় খুশীমনে বাসায় নিয়ে যাওয়ার দুদিন পর যখন আবারও সে বিছানা ভেজালো, তাতে বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহিত না হয়ে ভক্তিগদগদভাবে মা বললেন, "আটরশির পীরের দাওয়াই, দেরীতে হলেও কাজ করবেই। তোমরা বাপু বড্ড অস্থির! অত অস্থিরতা ভালো না, বুঝলে?"। এক মাসের পরে যখন রাসেল বিছানা ভেজানো বন্ধ করলো তখন পরিতৃপ্ত কন্ঠে মা পীরের গুনগান করতে লাগলেন।
মা গত হয়েছেন অনেকদিন। তবে মায়ের সৌজন্যে পাওয়া সেই তাবিজ রাসেল এখনও কোমড়ে বেঁধে রেখেছে। যেকোন ভয়-বাঁধা-বিপত্তি ইত্যাদি যা কিছু আসুক না কেন রাসেল কোমড়ের কাছে থাকা অলৌকিক দড়িটায় হাত বুলিয়ে নির্ভার হয়ে রাতে ঘুমুতে পারে। দুঃস্বপ্ন যে সে দেখে না, তা না, তবে দেখলেও তাবিজের সাথে 'বেয়াদবী' করা হবে মনে করে সেটা চেপে যায়। মানুষকে সে বড় মুখ করে বলে" কামের মতো কাম করছি ছোটবেলায় তাবিজটা নিয়া। আমার কোমড়ের তাবিজ। যেকুনো সমস্যায় সমাধান আপনা আপনি হয়ে যায়। পীরের কি নেয়ামত! সুবহানাল্লাহ!"
এই বলাটা যে তাকে প্রায় বলাৎকার করে ফেলবে সেটা কে জানতো! ফজরের নামাজের পর পার্কে গিয়ে কিছুক্ষণ জগিং করাটা তার বহুদিনের অভ্যাস। মিনিট দশেক জগিং করার পর সে যখন পার্কের বেঞ্চে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে, তখন কিছু মুখোশ পরা ছেলে এসে তাকে পাকড়াও করলো।
-কী মুরুব্বী! হাওয়া খাইতে আইছেন? মালডা দেন দিহি!
ছিনতাইকারীদের অপরিপক্কতায় বিরক্ত হলো রাসেল। এই সুবহে সাদেকের সময় পার্কে জগিং করতে এলে কেউ নিশ্চয়ই পকেট ভর্তি টাকা পয়সা নিয়ে আসবে না! কিছুটা তাচ্ছিল্য ভরা ঔদাসিন্নে সে নিজেকে সমর্পণ করে বললো,
"সার্চ কৈরা দেখো। কিছু পাইলে নিয়া যাও"।
ছিনতাইকারীদের উৎসাহের অবশ্য কমতি নেই। তারা তার শার্ট চেক করে কিছু পেলো না। রাসেল নির্ভার নিরুদ্বেগে বেঞ্চে বসে থাকলো। তারা যখন তার ট্রাউজারের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর আশেপাশে হাত চালাতে লাগলো, তখন কিছুটা অস্বস্তি পেয়ে বসলো তাকে। ছিনতাইকারীদের হাস্যমুখ ততক্ষনে কঠিন হওয়া শুরু করেছে। আশঙ্কার সাথে রাসেল ভাবলো কিছু টাকা ছিনতাইকারীদের জন্যে নিয়ে আসলেই ভালো হতো। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার অতি সাধের তাবিজের ওপর হাত দিলো দুর্বৃত্তরা।
-মালডা পায়া গেছি বস।
হাসিমুখে একজন জানালো। তারপর সাবধানে তাবিজের গিট্টু খুলে বস্তুটা তাদের নেতাকে দিলো।
-আপনে ভাবসিলেন আমরা হাইজ্যাকার, নেশাখোর তাই না? ভুল ভাবসিলেন। আমরা ঐসব খুচরা কাম করি না। আপনের তাবিজটা অপহরণ করলাম। আগামী তিন দিনের মধ্যে দশ লক্ষ টাকা দিয়া এটা ছাড়ায় আনবেন।
-এইটা কী করতাছেন ভাই!
ট্রাউজারের ফিতা হাতে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো রাসেল। ততক্ষণে ছিনতাইকারীরা পগারপাড়!
শোকস্তব্ধ রাসেল বাসায় গেলো ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে। তার স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যাসন্তান বাসায় সবসময় জবুথবু হয়ে থাকে রাসেলের চড়া মেজাজের কারণে। আর রাসেলও স্ত্রী-কন্যার ওপর বাড়তি খবরদারি করে নিজের পুরুষকারকে পুরষ্কৃত করা হয়েছে ভেবে সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু আজ এ কী বিদ্ধস্ত হাল তার!
-কী হৈসে তোমার?
শঙ্কিত কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করে।
-অপহরণ! অপহরণ করসে!
-কারে অপহরণ করসে? কেডা করলো?
-আমার তাবিজ অপহরণ করসে! সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার!
-কী কইলা? তাবিজ অপহরণ?
-হ! আমার তাবিজ নিয়া গেছে কুত্তার বাচ্চারা।
-তাবিজ অপহরণ করসে?
কোনমতেই বিশ্বাস হতে চায় না রাসেলের স্ত্রী রুমার। তার কন্যা নিলুও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়।
তাদের কথা এবং চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে সে বিলাপ করতে থাকে। তার বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ, পরকাল, ইহকাল, সবই বাঁধা ছিলো এই তাবিজে। অন্তত সে তাই মনে করে। এখন সে আবার ঘুমের ভেতর পেচ্ছাব করে বসবে নাকি ভেবে ডুকড়ে কেঁদে ওঠে সে।
আধাঘন্টা পরে ফোন আসে অপহরণকারী দলের নেতার তরফ থেকে।
-কী খবর রাসেল মিয়া? ভালা আছো? তাবিজের মুক্তিপণের কথা মনে আছে তো?
-আপনেরা কারা? কেন এমুন করতাছেন? আমি গরীব লোক।
-গরীব বড়লোক নিয়া তর্ক করবার চাই না। তিন দিনের মধ্যে পার্কের পশ্চিমপাশে মুক্তিপণের টাকা দিয়া যাইবেন। দশ লাখের থে এক টাকাও কম না। পুলিশে খবর দেয়াটা ঠিক হবে কী না এইডা আপনার বিচার।
টাকা রাসেল খুব একটা কম ইনকাম করে নি। দশ লাখ টাকা কষ্ট করে হলেও সে ম্যানেজ করতে পারবে। তবে তিন দিনের আগে টাকাটা না দেয়াই সমীচীন বলে সে মনে করলো। কোনভাবে যদি টাকা না দিয়েই তাবিজটা ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে ক্ষতি কী! এত ভালো তাবিজ আজকালকার দিনে পাওয়া দায়। সব জিনিসের মতো পীরেও আজকাল ভেজাল ঢুকে গেছে। মানুষের ভক্তিও আর আগের মতো নেই। কোন সাহসে কুলাঙ্গারেরা তাবিজ অপহরণের চিন্তা করে! ওদের কী কবরের আজাব আর হাশরের ময়দানের গজবের ভয় নাই?
ভয়। এই ভয়ের পিঠে চড়েই শৈশবটা কেটেছে রাসেলের। কোন একটা ভুল করে ফেললেই মায়ের বকুনি, সাথে নরকের শাস্তির বর্ণনা, এসব শুনতে শুনতে রাসেলের মধ্যে স্রষ্টার প্রতি ভীতানুভব গড়ে ওঠে। স্রষ্টার দয়াদাক্ষিণ্যের ভাগ তার পাতে কমই পড়েছে বলে মনে করে সে। তাই যে কাজটি নিজের মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে করা সম্ভব সে কাজটির সাথে স্রষ্টার সংযোগ না ঘটলে সেটি সম্পাদন করা অসম্ভব ভাবতো সে। মা তাকে শিখিয়েছে কোন সুরা পড়িলে কী হৈবে, কোন আমল করিলে কুফা কাটিবে, কোন স্বপ্ন দেখিলে কী হৈবে ইত্যাদি। তবে শুধু শাস্তির কথা না, "সোয়াব ইনকাম"এর ব্যবস্থা কীভাবে করা যায় তাও শিখিয়ে দিয়েছিলেন মা। তাই রাসেলের মনোজগতে নিয়মিত তোলপাড় হতো সোয়াব আর পাপের গণিতের দ্বারা। মিথ্যা কথা বলে এক বছর দোজখে স্বশ্রম কারাদণ্ড জারি হয়ে গেলে কোন একটা সূরা পড়ে সেটা কাটিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতো সে। এইসব নেকী-পাপ-সোয়াব ক্যালকুলেশনে তার কোমড়ে বাঁধা তাবিজটির ভূমিকা ছিলো ব্যাপক। যেহেতু এটা তৎকালীন সেলিব্রেটি পীরদের মধ্যে সুপারস্টার আটরশির পীরের দেয়া, তাই এটির প্রতি তার আস্থা ছিলো খুব। প্রথমবার যখন সে বাজে পাড়ায় গিয়ে যৌনকর্ম করে জিনাদার হলো, তার পরেই সে তাবিজটিতে হাত দিয়ে দুরুদ শরীফ পড়ে পাপমুক্ত হয়েছিলো। এ কাজটা অবশ্য নিয়মিতই করতে হতো। কারণ বাজে পাড়ার একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো সে। এর পর বয়স বাড়ার সাথে সাথে সে নতুন নতুন পাপের দেখা পেলো সে। মদ্যপান, ঘুষপ্রদান, সুদ গ্রহণ, চোখের পাপ, মুখের পাপ, কানের পাপ...চারিদিকে খালি পাপ আর পাপ। আকণ্ঠ পাপে নিমজ্জিত হয়ে সে তাবিজের ওপর হাত দিয়ে জিকির করতো। কাকতালীয়ভাবে এই তাবিজ তার মনোবাঞ্জাগুলো পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলো কয়েকবার। তাই এটাকে অন্যরকম গুরুত্বের সাথে দেখে সে। তার বিশ্বাস, এই তাবিজের জোরেই সে বেহেশত গমন করবে ঠিক ঠিক।
-এই শুনছো? নীলুর গা'টা গরম গরম লাগতেছে। ওকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও না।
রুনা দাবী পেশ করে রাসেলের কাছে। রাসেল তখনও তাবিজের শোকে কাতর হয়ে শয্যাশায়ী।
-কানের কাছে ভ্যানভ্যান কইরো না তো। একটু গা গরম হইলেই ডাক্তারের কাছে যাইতে হইবো এমন আহ্লাদ তো ভালো না।
-দুইদিন পরপর জ্বর হইতাছে মেয়েটার।
-হৌক গা। এরাম একটু আকটু হয়ই। আর আমি নিজেই তো বিছানায় পৈড়া আছি। রোগী মানুষকে খাটাইতে চাও, এইডা তোমার কেমুন বিবেচনা?
-তুমি সুস্থ মানুষ পার্ক থেইকা ফিরা আইসা এমন জ্বরের মধ্যে পড়লা কী ভাবে?
-আরে বেভুল মাইয়ামানুষ, কতবার কইরা কমু আমার তাবিজ অপহরণ করসে! দশ লাখ টেকা মুক্তিপণ চাইসে। দিতে না পারলে তাবিজটা ছিড়া ফালাইবো।
এমন ভয়ংকর সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে তার গা শিউরে উঠলো।
-ছিড়া ফেললে কী হবে! সামান্য একটা তাবিজ...
-চুপ থাক বেকুব মাইয়া! গুনাহগার মেয়েছেলে। তাবিজের মাহাত্ম্য তুই কী বুঝবি!
-আপনে তাইলে তাবিজ ছাড়ানোর জন্যে দশ লাখ টাকা দিবেন?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে রাসেল। এই তাবিজের মাধ্যমে সূরা পড়ে সে ঠিক কত নেকি কামাই করেছে, তার মূল্য দশ লাখ হবে কী না ভাবতে গিয়ে তার মাথায় জট পাকিয়ে যায়। তাবিজের পরলৌকিক মূল্যমানের সাথে ইহকালের মুক্তিপণ ঘোষিত টাকা ঠিক কীভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় তা ভাবতে ভাবতে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।
তার ঘুম ভাঙে সেলফোনের রিংটোনের শব্দে। অপহরণকারীদের নেতা ফোন করেছে।
-এত বেশি ভাবোনের কি আছে রাসেল সাহেব? আমরা কিন্তু ভিক্টিমকে টর্চার করা শুরু করুম।
এই তুলনাহীন ভিক্টিমকে ঠিক কীভাবে টর্চার করবে রাসেলের মাথায় আসে না। তার চিন্তাটা প্রকাশ্যরূপ পায় বিব্রত সংলাপে।
-তাবিজরে টর্চার? সেইডা কেমনে?
-আপনের তাবিজকে গরম পানির মধ্যে চুবামু। কেচি দিয়া কাটমু। রঙ জ্বইলা যাইবো। পাওয়ার কইমা যাইবো।
এমন সম্ভাবনার কথা ভাবতেও ভয় করে রাসেলের।
-আমারে আপনারা সময় দেন। তিন দিন তো সময় দিছেনই। আমি এর মধ্যেই টাকাটা যোগাড় কইরা ফালামু।
ফোন রাখার পরে সে পায়চারী করতে থাকে ঘরের ভেতর। মেয়েটা কোকাচ্ছে জ্বরের ঘোরে। ডাক্তারের কাছে নেয়া দরকার। নীলুর কাছে গিয়ে একটু বসবে নাকি? নাহ, স্রষ্টার পাক কালামের হেফাজত করতে পারে নি সে। এখন সন্তান সন্ততির ঋতুপরিবর্তন ঘটিত আহ্লাদী অসুখের পরিচর্যা করতে গেলে বিশাল বেয়াদবী হয়ে যেতে পারে। তাবিজটার অভাব পরতে পরতে অনুভব করছে সে। কোমড়ের কাছে কী যেন একটা নেই নেই! পারলৌকিক সুখের বন্দোবস্ত তো আছেই, এছাড়াও রয়েছে দীর্ঘদিনের অভ্যাস। নাহ, তাবিজটাকে ফিরে পেতেই হবে, ভাবে সে। তবে দশ লক্ষ টাকার মায়াও তো কম না। কোনভাবে যদি এমন বন্দোবস্ত করা যেত যে, সাপও মরবে আবার লাঠিও ভাঙবে না! যদি মুক্তিপণ না দিয়েই ফেরত পাওয়া যেত তাবিজটা! দশ লাখ টাকা তো ছেলেখেলার বিষয় না। দোনোমোনা করে পুলিসের কাছে ফোনটা করেই বসে সে।
-হ্যালো! মিরপুর থানার ওসি বলছি।
-ভাই! আমার অপহরণ হৈসে. দশ লাখ টাকা না দিলে ছাড়বে না। তিনদিন সময়।
-কে অপহরণ হয়েছে? আপনার ছেলে নাকি মেয়ে?
-না মানে... আমার তাবিজ, উনাকে ধরে নিয়ে গেছে কয়েকটা ছেলে।
-তাবিজ মানে? কী বলেন এইসব? ফাইজলামো করেন থানায় ফোন করে? পুলিসের প্যাঁচ তো দেখেন নাই। দিমু একেবারে দশমাসের জন্যে হাজতে ভৈরা! যত্তসব।
ফোন রেখে দেন রাগী অফিসার। রাসেলের দুর্ভোগ বাড়ে আরো। সে প্রায় একটা বক্ররেখার মত করে মাথাটা সামনের দিকে ঝুলিয়ে হাঁটে। দুর্ভোগ অর্কেস্ট্রাকে জমিয়ে তোলে তার মেয়ের জ্বরাক্রান্ত গোঙানি। তবে সেটা রাসেলের বর্তমান মনোভাবের প্রেক্ষিতে ছিলো ধীর এবং নিচু লয়ের। তাই সে শুনতে পায় নি।
এদিকে রাসেলের তাবিজ অপহরণের ঘটনাটা পাড়ায় চাউর হয়ে গিয়েছে। লঘু চিত্তের ফূর্তিবাজ ছোকড়া এবং প্রসাধন বিশেষজ্ঞ মেয়েরা এটাকে হেসে উড়িয়ে দিলেও ধর্মপ্রাণ গোষ্ঠীর মধ্যে রাসেলের পীরানুগত্য প্রশংসার দৃষ্টিতেই দেখা হয়। জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা অশ্রূ বিসর্জন করেন রাসেলের সৌভাগ্য কামনা করে। সমবেদনা জানাতে আসা প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা এবং উৎসাহ জানাতে আসলে রাসেল যখন টাকা ধার চাইলো, তখন তারা উদাস হয়ে জানলার বাইরের দৃশ্য দেখতে গিয়ে কেটে পড়লে আবারও একটা শোচনীয় অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় তাকে।
দেখতে দেখতে তৃতীয় দিন চলে এলো। অনেক কষ্টে শেষতক দশ লাখ টাকা যোগাড় করে ফেলেছে সে। এতগুলো টাকা দিতে গিয়ে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। কিন্তু কী আর করা! এই তাবিজের মাধ্যমে সে ইহকালের বালা মুসিবত থেকে মুক্তি পাবে, আবার পরকালের লোভনীয় অনন্ত জীবনের টিকেটও পেয়ে যাবে। কত্ত সোয়াব সে বাগিয়েছে তাবিজের মাধ্যমে তার লেখাজোখা নেই। সে তুলনায় দশ লাখ টাকা খুব বেশি কি? সে টাকা নিয়ে বের হতে যাবে পার্কের দিকে, তখন তার পথরোধ করে দাঁড়ালো রুনা।
-কই যান আপনে?
-সেইডা দিয়া তোমার কী? যাইতেছি এক কাজে।
-দশ লাখ টাকা নিসেন তো? মুক্তিপণ দিতে যান?
-এই তো বুইঝা ফালাইসো। এখন পথ ছাড়ো।
-পথ ছাড়বো মানে? আপনেরে আজ ধরসি, কোনো ছাড়াছাড়ি নাই।
-মানে কী! এইসব কী কৈতাসো?
-মানে হৈলো গিয়া, আপনের মাইয়াডা আজকে তিনদিন ধইরা জ্বরে আক্রান্ত আপনে একবারও দেখতে আইছেন? নিজের মেয়েরে যদি অপহরণ করতো তাইলেও মনে হয় আপনি এত পেরেশান হইতেন না।
কথাটি একেবারে ফেলে দেবার মত না। তাই রাসেল চুপ করে থাকে। রুনাকে ঠেলে দিয়ে সে গম্ভীরভাবে এগিয়ে যায়।
পার্কের নির্দৃষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর পর সে দেখতে পায় অপহরণকারীরা সময়নিষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে আগেভাগেই গিয়ে বসে আছে।
-আয়া পড়ছেন রাসেল সাব? মালপানি ঠিকঠাক মতো আনছেন তো? দেখি।
রাসেল তাদের কাছে টাকাগুলো হস্তান্তর করে।
-গুড। খুবই ভালা। এখন যান। বাসায় গিয়া সুন্দর একটা ঘুম দেন।
-আমার তাবিজ? আমার তাবিজ!
আর্তনাদ করে ওঠে সে।
-আরে তাবিজ তো আমাগো কাছে থাকতাসেই। অত টেনশন করেন ক্যা?
-আপনেগের কাছে থাকতেসে মানে কী!
-মানে হৈলো গিয়া, তুই দোজখে পুইড়া মরবি হারামখোর নাফরমান। সোয়াব তো দূরের কথা, তাবিজের খেদমত করতে না পারার কারণে কবিরাহ গুণা অর্জন কৈরা দোজখে পুড়বি হাজার বছর।
-আচ্ছা আপনেরে একটা চান্স দেই,
আরেকজন বলে পাশ থেকে,
-আপনার অসুইখ্যা মাইয়াডারে অপহরণ করুম। তারপর টাকা চামু। চিন্তা কইরা দেখেন, বারোমাসি অসুইখ্যা একটা মাইয়া যে আপনার টাকা লস করতাসে খালি, আর এইদিকে টুইনওয়ান তাবিজ দিয়া ইহকাল আর পরকালের বন্দোবস্ত করতাসেন ঠিকঠাক। এখন আপনার মাইয়াডারে যদি আমগোর কাছে দেন, তাইলে তাবিজডা ছাইড়া দিমু। আপনি মরার পর মুনকার নাকিরের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিবেন, হাশরের ময়দানের পেরেশানি থিকা বাঁচবেন, আর তারপর তো বেহেশতের চিরসুখী জীবন। ভাবেন। খুব খিয়াল কৈরা ভাবেন।
রাসেল ভাবে। তার মেয়ে। একমাত্র মেয়ে। ওদিকে দুই ভুবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী অলৌকিক বস্তু। কোনটার দাম বেশি? সে তার শৈশব থেকে যৌবন পর্যন্ত তাবিজের মাধ্যমে প্রাপ্ত সকল উপকারের কথা ভাবে। সে ভাবে বেহেশতের সুপেয় মদ, চিরযৌবনা নারী আর গেলমানদের কথা। সে ভাবে। ভাবতে থাকে। শুধু ভাবতেই থাকে।
সে ভাবে। রাসেল ভাবে। রাসেলরাই শুধু ভাবে। রাসেলরা, বিশ্বাসের রণহুংকার দিয়ে তাড়া করে বেড়ায় পৃথিবীর ছোটখাটো সুখ, টুকরো অনুভূতি, স্ত্রীর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সন্তানকে কোল থেকে ছুড়ে ফেলে তারা এগুতে থাকে সাত আসমান ভেদ করে বেহেশতের দিকে...

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মৃতবৎসা জোছনার কাল

তোমার জন্যে শুভ্র গোলাপ, বেড়ালতমা -হামিম কামাল