একটা ছোট্ট পরী অথবা প্রজাপতি আর একটা আমরা

অনেকদিন পরে আমরা আজ একসাথে হলাম। আমাদের রক্তসম্পর্কীয় এক অনুজের জন্মদিবসে রঙচঙে সব উপহার নিয়ে চমৎকার একটা সন্ধ্যা কাটানোর প্রত্যাশায়। সেই কবে আমরা এক হয়েছিলাম, মনেই নেই। পুরোনো হৃদ্যতার জীর্ণ কাপড়ে সেলাই করার উদ্দেশ্যে আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, মহল্লার আশপাশের বাড়ি থেকে, পশ্চিমের দূর দেশ উড়ালপথে অথবা আরও আরও অনেক দূর থেকে এসেছি আজ। আমরা কেউ কাউকে তারবার্তা বা তড়িৎবার্তা পাঠাইনি। আমাদের শিরা-উপশিরা, ধমনী থেকে রক্তের এক ভীষণ জলোচ্ছাস ভাসিয়ে নিয়ে এসেছিলো সবাইকে, নিউরনের আনাচে কানাচে চঞ্চল সংকেত টের পাচ্ছিলো যেন সবাই।
আমাদের পারস্পরিক সম্ভাষণ ছিলো আবেগময়, স্মৃতিবিজড়িত এবং আন্তরিক। আমরা আমাদের ছটফটে ছোট্ট অনুজের খুশী দেখে দৈনন্দিন কৃশ ক্লিশতা ভুলে গিয়েছিলাম।
"তোমরা সবাই আসবে আমি ভাবতেও পারিনি!"
বলল ছোট্ট লাল টুকটুকে।
"বিশেষ করে বাসার সামনে যখন বিমানটা নামল আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম প্রচন্ড শব্দে!"
"তোমার জন্যে সব কাজ ফেলে এসেছি ছোট্টমণি! ভাবতে খারাপ লাগছে যে কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে যেতে হবে সেই মন খারাপ করা শীতল দেশে"
ম্লানমুখে বলল দূর পশ্চিমের এক দেশ থেকে উৎসবে সামিল হওয়া আমাদের আত্নীয়টি। শুনে আমাদেরও মন কেমন কেমন করতে লাগলো।
"আমার কথা কিছু বললেনা? আমি সেই কত্তদূরের নদী অধ্যুষিত এলাকা থেকে পাড়ি দিয়ে এলাম এখানে। তোমার বাড়ির পাশের ডোবাটায় যখন আমার নৌকোটি ভেরালাম, একটুও চমকাওনি ছোট্ট প্রজাপতি?"
আদুরে আর আহলাদ ভরা কন্ঠে সুধোয় একজন।
প্রজাপতি আর কি বলবে! সে এখন উড়ে বেড়াতে ব্যস্ত। তার বর্ণীল ডানায় আমরা রঙ এর নামতা পড়ি, ভুলে যাই ভড়ং এর রোজনামচা। উজ্জ্বল এবং উচ্ছল হয়ে ওঠে মুহূর্তগুলো।
আমাকে অবশ্য ওদের মত অত দূর থেকে আসতে হয়নি এখানে। আমার নিবাস আশেপাশে বলেই যোগাযোগ ব্যবস্থাটা মোটেও ঝঞ্ঝাটের নয়।
হাঁটাপথ। আমি পথ ভুলে গিয়েছিলাম অবশ্য....
কতদিনের বিরতি না! তবে একে ওকে জিজ্ঞেস কে সহজেই চিনে নিয়েছিলাম সেই বাড়িটা।
তবে তা ছিলো তালাবদ্ধ। অনেকক্ষণ লৌহনির্মিত সুরক্ষিত দরজাটা ধাক্কানোর পরেও কেউ খুলছিলোনা। আমি ওপরে তাকিয়ে দেখেছিলাম বারান্দায় প্রজাপতির ছটফটানি। আমার হাতের উপহারভর্তি থলে দেখে সে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলো খুব। কিন্তু কেউ চাবি খুঁজে পাচ্ছিলোনা। অবশেষে আমি জানালার কার্নিশ, জলের পাইপ এবঙ আরো বিবিধ বস্তুকে অবলম্বন করে ওপরে উঠে আসি।
এখন আমি উপভোগ করছি উৎসবের চমৎকার মুহূর্তগুলো।
সুসজ্জিত এবং ঝলমলে মুখগুলোর মাঝে একজনকে বড় বেমানান লাগে। হঠাৎ করে অনাহুত এক আগন্তুককে আমরা দেখতে পাই। অস্তিত্ব অস্থিসজ্জিত। তার শরীরে কোন পোষাক নেই, নেই মাংস, নেই শিরা-উপশিরা। সে খুব সংকুচিতভাবে আমাদের মাঝে আসে,
"ছোট্ট পরী, আমি তোমার জন্যে কিছু নিয়ে আসতে পারিনি। আর থাকতেও পারবোনা বেশিক্ষণ। শুধু তোমাকে একবার দেখতে, আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি..."
ছোট্ট পরী সংশয় মাখা চোখে তাকিয়ে থাকে এই অদ্ভুত বিসদৃশ্য আগন্তুকের দিকে। কিন্তু আমাদের মোটেও ভুল হয়না তাকে চিনতে। আমরা ছোট্ট পরীর সাথে তাকে পরিচিত করিয়ে দিতে উদ্যোগী হই, কিন্তু সে নিমিষেই মিলিয়ে যায় কোথায়!
যেন সে কোথাও ছিলোনা কোনদিন।
ও কি আর ফিরে আসবে কখনও? আমাদের মনে পড়ে সেই বর্ষারাতের কথা। একটা হাসপাতাল, কিছু চিকিৎসক, সেবিকা, ঔষুধপত্র আর কিছু ভেজাচোখের কথা।
আমরা বিষণ্ণ হয়ে উঠি। কিন্তু আজ এখানে যাবতীয় বিষণ্ণতা এবং নিস্তব্ধতার ছুটি। এক মুহূর্তের ধূসর স্তব্ধতায় লীন হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের চোখে পড়ে ছোট্ট পরীর অভিমানে ফুলে ওঠা গাল আর সজল চোখ। একটুও অবহেলা আর অমনোযোগ সইতে রাজী না সে আজকের এই সন্ধ্যায়।
আমাদের উপহার প্রদান এবং উৎসব উপলক্ষ্যে তৈরী করা সুস্বাদু সব খাদ্য গলাধঃকরণের শেষ হলে অনুষ্ঠানটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্যে কি করা যায় সে পরিকল্পনা করতে থাকি।
ছোট্ট পরী প্রস্তাব দেয় মজার মজার ঘরোয়া সব খেলায় অংশগ্রহণ করার।
" "নাম-দেশ-ফুল-ফল" খেলবা?" উৎসাহী কন্ঠ তার।
আমরা সবাই হাসি শিশুতোষ এ খেলার কথা ভেবে। কেউ কেউ আপত্তিও করে।
"নাম!" আমি যে সবার নাম ভুলে গেছি!"
"দেশ! আমি যে দেশ হারিয়ে ফেলেছি!"
সুতরাং প্রস্তাবটি সর্বসম্মত না হওয়ায় আমরা তা নাকচ করে দিই।
এরপরে ছোট্ট পরী বলে চোর-ডাকাত-পুলিশ খেলার কথা।
কিন্তু এতে আরো প্রবল আপত্তি তোলে সবাই। আমিও এ খেলার ঘোর বিরোধী। আমাদের ছোট্ট পরী বা প্রজাপতিটি কষ্ট পেতে পারে জনেও বলেই ফেলি,
"আমাদের স্মৃতিগুলি চুরি হয়ে গেছে, আমাদের সময় ডাকাতে নিয়ে গেছে। আর এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে যদি অনুভূতিখেকো পুলিশের দল এসে আমাদের পাকড়ে নিয়ে যায়, তখন কি হবে!"
ছোট্ট পরী কাউকে হারাতে চায়না, যেমনটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি সবকিছু বা অনেকিছুই। তাই সে কিছু বুঝে বা না বুঝেই আমার কথা মেনে নেয়।
এবার সে লুকোচুরি খেলতে চায়। আমরা আর না করিনা। কিছু একটা খেলতে হবে বলেই, কারণ সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমাদের সময়ের মজুত তো আর অঢেল নয়!
খেলাটিকে প্রাণবন্ত এবং উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলতে সব বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। আমরা সবাই লুকোই পুরোনো সিন্দুক, বুকশেলফ, ওয়ার্ডরোবে অথবা বিছানার তলে।
ছোট্ট পরী অন্ধকার ভয় পায় খুব। কিন্তু এখন সে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা। আমরা সবাই আছিনা তার সাথে! সে ছুটোছুটি করে বেড়ায় মনের আনন্দে। আমি বিছানার তলায় লুকিয়ে এসব মনশ্চক্ষে দেখে তৃপ্তি পাই। আমাদের প্রিয় টুকটুকি!
কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সে খানিক দিশেহারা আর উদভ্রান্ত হয়ে ওঠে। কাউকে খুঁজে পায়না সে। কেউ কোন সারাশব্দ করেনা। অন্ধকারে প্রস্ফুটিত হতে থাকে ভয়ের শরীর। ছোট্ট পরী ভয় পায়। সে চিৎকার করে ওঠে।
"এই তোমরা কোথায়! বেরিয়ে এসো! এ খেলা আর ভালো লাগছেনা আমার!
কিন্তু কেউ কোন শব্দ করেনা।
"এই আমি ভয় পাচ্ছি কিন্তু!" কাঁদোকাঁদো কন্ঠস্বর তার। আমার মায়া লাগে খুব। আমি উঠে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে দিই।
কিন্তু আলোটা বড্ড ম্রিয়মাণ লাগে। এতক্ষণের ঝলমলে আলো, রাংতায় মোড়া উপহার, রঙচঙে বেলুন, আর মানুষগুলো.... সব উধাও!
আমি হঠাৎ খেয়াল করি যে, আমি কোন সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমে না, বরং সিঁড়িঘরের তালাবদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়ানো। আমি কলবেল টিপি। বাসার রক্ষণাবেক্ষণকারী দরজা খুলে দেয়। আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি।
"হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ জুহানা!" আমি তাকে শুভেচ্ছা জানাই।
"থ্যাংকিউ" রিনরিনে কন্ঠটা বড় নিস্প্রভ শোনায়।
"আর কেউ আসবেনা?" সে জানতে চায় ব্যাকূল কন্ঠে।
"আর কেউ কি আসেনি!" আমার কন্ঠে বিস্ময় প্রকাশ পায়।
যদিও জানি যে বিস্মিত হবার কোন কারণ নেই।
কোন মানে নেই।

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মৃতবৎসা জোছনার কাল

তোমার জন্যে শুভ্র গোলাপ, বেড়ালতমা -হামিম কামাল