খাদ্যতালিকা

খাদ্য তালিকা
সকালবেলা- পাউরুটি, ডিমপোচ/ভাজি, জেলি/মাখন।
দুপুরবেলা-বেশি করে মাংসের অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসা বিশেষরকম তেহারী।
রাতেরবেলা- ভাত,মুরগীর ঝোল,ভুনা, অথবা গরুর মাংস।
যথেষ্ট পরিমাণ প্রোটিন ভক্ষণ করার পরে আরো রাতে কখনও কখনও আরো মাংস দরকার হয়। সবজী খাই না আমরা। সবজী বিস্বাদ লাগে। খাদ্য থেকে অর্জিত মাংস আমাদের দেহকে সুপুষ্ট এবং শক্তিশালী এবং সক্ষম করে।
-ডিনার রেডি বেইবি!
আজকে বিশেষ একটা দিন ছিলো আমাদের। রান্নাবান্নার ঘটা চলছে সন্ধ্যা থেকেই। অনেক অতিথি এসেছিলো বলে আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছি পুরান ঢাকা থেকে কাচ্চি বিরিয়ানি নিয়ে। সন্ধ্যায় প্রচুর মাংস খাবার পরেও বাসায় তৈরী গরুর মাংসের সুঘ্রাণে ক্ষিধেটা চাগিয়ে ওঠে। কালকে সকালের নাস্তাটাও জম্পেশ হবে। প্রচুর উদ্বৃত্ত থাকবে। ডিমপোচের বদলে বাসি পোলাও অথবা পরোটা-মাংস দিয়ে শুরু হবে আরেকটি দেহসারযুক্ত দিন।
*
কসাইখানার পরিবেশ আমার বিচ্ছিরী লাগে। এখানে সেখানে পড়ে থাকে রক্ত,চর্বি,বর্জ্য। তবে ভালো মাংস পেতে হলে কসাইখানাতেই যেতে হয়। আমার এক পরিচিত দোকান আছে ওখান থেকে আমি ভালো খাশীর মাংস কিনি। বাঁধা থাকে, চোখের সামনেই জবাই দেয়। ভালো ভালো অংশগুলো আমি নিজে বেছে নিই। আমার স্ত্রী মাংস রান্নায় পটু। সে নানারকম পদ জানে। আমি অবশ্য সবগুলোর নামও জানিনা ঠিকমত।
সে আমাকে নিয়মিত সুস্বাদু মাংস সরবরাহ করছে এতেই আমি সন্তুষ্ট। স্ত্রী এবং কসাই, এই দুই প্রজাতি আমাকে বেঁচে থাকার রসদ যোগায়।
মাংস শুধু খেয়ে তৃপ্তি না, দেখেও তৃপ্তি। আমার চারিপাশের মাংসল নারীপুরুষের দল যখন একত্রিত হই কোন উৎসবে উপলক্ষ্যে, তখন আমাদের শরীর থেকে বিকিরিত মাংসরশ্মি সকলের আঁধারচশমা ভেদ করে প্রলয়সংকেতের উদ্বোধন করে, আর আমরা বুঁদ হয়ে রই একে অপরের ঘ্রাণে।
আমার মাঝেমধ্যে অন্যরকম মাংস খেতে ইচ্ছে করে। শুধু আমার একার না, আমি জানি সকলেরই করে। কারো ইচ্ছে করে আমার মাংসের স্বাদ নিতে, কারো ইচ্ছে করে আমাকে দিতে, কিন্তু কেউ কেউ আবার এই মিট-গো-রাউন্ড খেলায় তেমন একটা আগ্রহী না। তাদেরকে কব্জা করা ঝামেলা বটে, তবে মাংস বিকিকিনির মেলায় শেষপর্যন্ত সবাইকেই দেখা যায়।
মেলা
এবারের মাংসের মেলাটা খুব জমেছে। আমি পকেট থেকে লিস্টটা বের করে যাচাই করে দেখি চাহিদামতন পণ্য এসেছে কী না। সেদিন রাত্রে উৎসব এবং ভোজের পর থেকে আমার লিস্টে এ পর্যন্ত তিনজন মাংসময় পুরুষ/নারী যোগ হয়েছে। তাদের কাউকে আমি চাটনি বানিয়ে খাবো, কাউকে চাপ বানিয়ে, কারো শুধু গন্ধ নেবো।
একমাত্র প্রকৃত মাংশাসীরাই জানে মাংসের ফুলের সুবাস নিতে।
লিস্ট
১/ শায়লা- তার মাংসের গন্ধে আমি মাতোয়ারা হয়ে আছি অনেকদিন ধরেই। আর সে আমার কলিগ বলে গন্ধটা আরো তীব্রভাবে প্রতিনিয়ত পেয়ে থাকি। সেই উৎসবের রাতে সেও এসেছিলো। বিদেশী পারফিউমের মাদকতাময় সুবাসের প্রশংসা করছিলো সবাই, আর আমি, আহ আমি! প্রাণভরে নিচ্ছিলাম তার মাংসের গন্ধে ভারি হয়ে আসা আর্দ্র বাতাস।
২/আনোয়ার হোসেন- এর মাংসের গন্ধ খুবই কটূ। একে আমি খেতে চাই না। মাথার মধ্যে হাতুড়ি দিয়ে একটা বাড়ি দেবো, তারপর তার থ্যাৎলানো অংশ টেনে ছিড়ে বের করে চামড়া ছিলে টাঙিয়ে রাখবো এমন কোন জায়গায় যেখান থেকে সবাই দেখতে পাবে। হারামজাদার এত সাহস! আমার সাথে তর্জনী দেখিয়ে আদেশের ভঙ্গীতে কথা বলে! সেদিন আমাদের বাসায় নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলো তার পায়াভারী পশ্চাদ্দেশ নিয়ে। আমার ব্যক্তিগত মাংসভান্ডারের দিকে জুলজুল করে তাকিয়েছিলো। ঊর্ধতন কর্মকর্তা বলে সব সয়ে যেতে হয়।তবে লিস্টে রেখেছি। আজকেই মেলা থেকে কিনে নিয়ে যাবো তার কয়েক কেজি মাংস।
৩/ জেনি- হাহাহা! জেনি লাইকস দ্যা গেম মিট -গো -রাউন্ড। জেনির মাংসের স্বাদ আমি নিয়েছি বেশ কয়েকবার। তবে তৃপ্তি মেটেনি। ঘুরেফিরে বারবার এই পৃথুলা প্রতিবেশিনীর মাংসস্থ হতে হয়। সপ্তাহে অন্তত একবার জেনির মাংস আমাকে খেতেই হবে।
লিস্টের সবাইকে খুঁজে পেতে খুব একটু সমস্যা হল না। যদিও সমস্যা হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। তবে কসাইখানায় যেমন আমার পরিচিতজন আছে এই বিশাল মেলাতেও স্টল সাজিয়ে বসেছে আমার শুভানুধ্যায়ী একজন। সেই আমাকে খুঁজে বের করল।
-হ্যালো স্যার! এদিকে,এদিকে!
স্টলের ভেতর ঢুকে আমার মন ভালো হয়ে গেলো। কসাইখানার মত নোংরা না। খুব টিপটপ।জিনিসপত্র সাজানো চমৎকারভাবে সাজানো। আর দোকানদারটাকেও খুব চেনা মনে হল। কার মত যেন দেখতে... সে যাকগে! আমার লিস্টের তিনটি পণ্যকেই পেয়ে গেলাম।
-দেখে শুনে বেছে নিন কোনটা নেবেন।
তিনজনই খুব ছটফট করছে। আমি প্রথমে শায়লার কাছে যাই। তার নরম তলপেটে হাত দিয়ে স্মিত হাসি খেলা করে আমার মুখে।
-এখান থেকে এক কেজি কেটে দাও। সুন্দর, স্লাইস করে।
-ওকে স্যার দিচ্ছি। আর কী কী লাগবে দেখেন।
মিস্টার আনোয়ারের মাথা থেকে এক কেজি ধুসর কোষ অর্ডার দিই আমি। ওকে পরাভূত করতে এই জিনিসটাই সবচেয়ে বেশি দরকার। তবে এক্ষেত্রে বেশ ঝক্কি পোহাতে হল। তার মাথা থেকে প্রয়োজনীয় অংশটা নিতে গিয়ে স্টলের সুদক্ষ কর্মীরাও গলদঘর্ম হয়ে গেল। রক্ত, চর্বি এবং পাশবিক চিৎকারে আবারও সেই কসাইখানার মত পরিবেশ। ওরা সামলাক! আমি জেনির কাছে যাই। জেনি খুবই সস্তা। তাই ওর থেকে কেজি হিসেবে না কিনে পুরোটাই নেব ভাবি।
-এইটা আস্ত নিবো। দাম কত?
-দাম তো আপনার জানাই আছে স্যার, কেন মিছে দরাদরি করছেন!
তা ঠিক। ওরা যে দাম বলল, তাতে দর কষাকষির কোন দরকারই পড়লো না। তবে এরকম নিখুঁতভাবে মিলে যাওয়াটাও একটা রহস্য!
আমি মাংস এবং মগজের ব্যাগ আর দড়িতে করে জেনিকে বেঁধে নিয়ে স্টল থেকে বেরুই।
মেলা দারুণ জমে উঠেছে। মানুষের ভীড়ে জেরবার অবস্থা। প্রস্থান ফটক দিয়ে বের হবার সময় হঠাৎ খেয়াল করি আমার স্ত্রী প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকছে। আমি আর ওকে ঘাঁটালাম না। আমরা বানিজ্যমেলা, বইমেলায় একসাথে যাই, অথবা একসাথে না গেলেও বাসায় ফিরে ক্রয়কৃত দ্রব্যাদী একে অন্যকে দেখাই। কিন্তু এই মেলার ক্রয়কৃত বস্তু সম্পর্কে আমরা কখনও একে অপরকে জিজ্ঞাসা করি না। আমার গোপন আলমিরাতে এসব রেখে দিই, যার খোঁজ সে কখনও পাবে না আমি জানি। যেমন আমি তারটা জানি না...
*
-ডিনার রেডি হানি!
-আজ তুমি কী রেঁধেছো?
-আজ আমি কী রেঁধেছি!
সে গুনগুন করে একটা হারিয়ে যাওয়া গানের সুর ভাজে।
-এটা কার গান যেন?
-"আজ আমি কী রেঁধেছি" -নাজমা জামান, সত্তরের দশক, জিংগা শিল্পগোষ্ঠী নামে একটা গানের দল ছিলো ওদের।
-ওহ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সত্তরের দশক বড় ভালো সময় ছিলো।
-এখনই বা খারাপ কী! এখনকার মত সুলভে মাংস পাওয়া যেত না তখন।
-হয়তো বা না, হয়তো বা যেতো, কে বলতে পারে! আমরা তো মাংসের স্বাদই নিতে শিখি নি তখন!
-তা অবশ্য ঠিক বলেছো।
-আচ্ছা শোন, আজ ডিনারের পর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ব বুঝলে?
-নোও প্রোবলেমোও!
সে যেন একটু খুশিই হয়! উচ্ছল হাসিতে টেনে টেনে তার সম্মতি জানায়।
আলমারি
কিছুক্ষণ ঘুমানোর ভান করে মটকা মেরে পড়ে থেকে আমি সাবধানে তার দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাসের গতিবিধি, বুকের ওঠানামা, র‌্যাপিড আই মুভমেন্ট খেয়াল করে সন্তর্পণে বিছানা থেকে নামি। পা টিপে টিপে ডিনাররুম পেরিয়ে আমার গোপন আলমিরার দিকে যাই। মাংস সংরক্ষনের জন্যে আলমিরার বদলে ফ্রিজ হয়তো উপযুক্ত ছিলো বেশি, তবে আমার এই বিশেষরকম মাংসগুলো এখানেই ভালো থাকে। রাতের বেলা ক্ষুধা পেলে ইচ্ছে করলেই ওভেনে করে ভাত-তরকারি-মাংস গরম করে নেয়া যায় অথবা বিছানাবর্তিনীকে অল্প আঁচে গরম করে তপ্ত উনুনে আগুনকেলি করা যায়। তবে সবরাতে ক্ষুধা একরকম থাকে না। কোন কোন রাতে আমাকে এই আলমিরার দ্বারস্থ হতে হয়। আজকে কেনা টাটকা খাবারগুলোর কথা ভেবে আমার জিহবা রসালো হয়ে ওঠে। স্টল থেকে কেনা শায়লাপিন্ড নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ নিই। আহ সুবাস! মাংস এবং রক্তের ফুল। এটাকে কবে রসিয়ে রসিয়ে খাবো সেই সুখকল্পনায় মজে থেকে স্নিফ করার ফলে অনুভূতিটা দারুণ হয়!
এইবার জনাব আনোয়ার হোসেন, ঊর্ধতন কর্মকর্তা। নাহ, তার দামটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। তাকে কিনতে, ভক্ষণ করতে আমার আরো অনেক সময় লাগবে। আপাতত তার মগজটা থেকে এক চামুচ কেটে নিয়ে কাঁচা খেয়ে ফেলার চেষ্টা করি। উহ! বিকট গন্ধ। ভাজি করে খাওয়া যেতে পারে। তবে আজকে থাক।
সবশেষে আমি জেনির কাছে যাই। আলমিরার এক তাকে চুপ করে শুয়ে ছিলো লক্ষী মেয়ের মত। আমাকে দেখে অন্ধকারে তার চোখ জ্বলে উঠলো কামনায়। আদর করে কোলে নিয়ে নামাই ওকে...
ঘন্টাখানেক পরে বিছানায় ফিরে যাবো যখন, মনে হল একটা ছায়ামূর্তি দ্রুত সরে গেল। চোর টোর না তো? সচকিত কিছুক্ষণ কাটলো অনুসন্ধানে। আমাদের ফ্ল্যাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্ছিদ্র, চোর আসার সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরেও, সাবধানের মার নেই!
বিছানায় ফিরে দেখি আমার স্ত্রী সেই একই ভঙ্গীমায় শুয়ে আছে। তবে নিঃশ্বাসটা একটু দ্রুত হচ্ছে মনে হল, আর ঘেমেছেও কিছুটা। ক্লান্তিজড়িত একটা প্রশান্তির হাসি তার ঠোঁটে, খুব লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। আমি নিজেও ক্লান্ত। পাশ ফিরে শুয়ে পড়ি।
*
-ব্রেকফার্স্ট রেডি ডিয়ার!
-ইয়েস মাই টেডি বিয়ার! আসছি।
শেভ করতে করতে আমি বলি। আরো একটা চমৎকার দিনের শুরু হতে যাচ্ছে সুখাদ্য এবং আদুরে সম্বোধনের মাধ্যমে। টেবিলে বসে আমার মধ্যে বেশ একটা চনমনে ভাব তৈরী হয়।
-আজ তো ছুটির দিন। চলো শহরের বাইরে কোথাও ঘুরতে যাই।
-কোথায় যাবা?
-কোথায় যাওয়া যায়... উমম... গ্রামের দিকে চল। দুইপাশে সবুজ শষ্যক্ষেত্র, পাখির ডাক, বাতাসে বিবাগী সুর...
-উফ! চল চল এক্ষুণি চল! তাড়াতাড়ি নাস্তা শেষ কর কেমন? আমি রেডি হচ্ছি। পাঁচ মিনিট লাগবে।
পাঁচ মিনিটের কথা শুনে আমার হাসি পায়। আমি হাসতে হাসতেই বলি,
-আচ্ছা যাও, ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার নাস্তা শেষ হবে।
তার চপল পায়ে চলে যাওয়া আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখি। তবে মুগ্ধতা বেশিক্ষণ থাকে না সেলফোনের কর্কশ শব্দে। যদিও রিংটোনটা ছিলো বিতোভেনের সিম্ফনি, কিন্তু এই মুহূর্তে ওটাই আমার কাছে পৃথিবীর কর্কশতম শব্দ। বলা যায় না, ছুটির দিনেও বরাহ শাবকটা...ভাবতে ভাবতে আমি ফোন ধরি। যা ভেবেছিলাম তাই। ওপাশ থেকে গুমগুম করে নিগমবদ্ধ সৃষ্টিশীল আদেশ বয়ান করছেন জনাব আনোয়ার হোসেন,
-হ্যাল্লো! গুড ডে! স্যরি টু সে, আজকের ছুটিটা আপনাকে বাতিল করতে হবে। কাম শার্প টু অফিস এ্যাজ আর্লি এ্যাজ য়্যোর এ্যাস ক্যান মুভ।
-ইয়েস স্যার!
-আমি জানি সৃষ্টিশীল কাজে আপনি গড়িমসি করতে পছন্দ করবেন না মোটেও। সেদিন আরডিসি'র যে স্ক্রিপ্টটা লিখেছিলেন...
-স্যার ওটারতো রেডিওতে ভয়েসওভারও হয়ে গিয়েছে...
-উহু, আবার নতুন করে করতে হবে। ক্লায়েন্টের পছন্দ হয় নি। দেখুন সৃজনশীল কাজের ব্যাপারে এরকম অনীহা করলে কী করে হবে! ব্রেইনটাকে কাজে লাগান! আপনার এই অনীহার কারণেই এখনও নীচে পড়ে আছেন। ইউজ ইয়োর গ্রে সেলস ম্যান! ওগুলোতে মরীচা পড়ুক, আমি আন্তরিকভাবেই তা চাই না। কাম শার্প। বাই।
ফোন রাখার পর আমি কাঁটাচামচ দিয়ে নির্মমভাবে ডিমপোচটাকে খোঁচাতে থাকি।
-আমি রেডি!
কী আশ্চর্য, ঠিক পাঁচ মিনিটেই আজ সে রেডি হয়ে গেছে!
-ও আচ্ছা ঠিক আছে!
হতাশ কন্ঠে বলে সে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে নেয়।
*
কাজটি শেষ করতে আমার টানা পাঁচ ঘন্টা লেগে যায়। এরমধ্যে নানারকম ঠেস দেয়া কথা, টিপ্পনি, এমন কী হুমকি ও শুনতে হয়েছে, ছাঁটাইয়ের। আমার ভেতরের প্রবল প্রতিবাদ গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে থাকে। আমি বারেবার আলমিরায় রক্ষিত তার রক্তাক্ত মগজটার কথা ভাবতে থাকি। কিন্তু মনোযোগ সেদিকে বেশিক্ষণ থাকে না, ভয় এবং অপমানের বন্ধনীতে বাঁধা পড়ে। দুপুরবেলায় আমি তেমন ক্ষুধাও অনুভব করি না। আমাকে লাঞ্চ হিসেবে দেয়া হয় বাসি ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ। কোনক্রমে বমি চেপে আধখানি খেয়ে কাজে মনোনিবেশ করি।
তবে শেষতক কাজটা ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়। ক্লায়েন্ট এবং বস সবাই খুশি।
সে আমাকে উদার আমন্ত্রণ জানায় আরেকটি মাংসোৎসবে যাবার জন্যে। আমি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে চলে আসি। এখন ভাবছি কোথায় যাওয়া যায়। এই অসময়ে বাসায় গিয়ে কী হবে! মেলায় যাওয়া যাক বরং আবার। দেখি নতুন কিছু এসেছে কী না! আমি আবারও ক্ষুধার্ত বোধ করি।
আবার মেলায়
-ব্যবসাপাতি ভালো যাইতাছে না। কী কর তোমরা?
-ওয়েট করেন বস, আইজকা একটা ভালো মাল পামু। হটকেকের মত বিক্রী হইবো।
-চাপাবাজী ছাড়ো!
-আরে দেহেন না কী করি।
মেলায় ঢোকার পর থেকে আমার মনে হয় সামথিং ইজ রং! কেমন যেন অচেনা ঠেকছে জায়গাটা। কই আমার সে চেনা দোকানপাট, স্টল সেলসম্যান? কোথায় সে পরিচিত গন্ধ? আরে! সাইনবোর্ডটাতো আগে খেয়াল করি নি! এটাতো সবজীমেলা, ধুর! খামোখা সময় নষ্ট হল। এখন আবার ফেরত যাওয়া সেটাও উল্টোপথে। ভাবতে না ভাবতেই কারা যেন আমাকে বেঁধে ফেলে,
-পাইছি বস! এইটার কথাই কইসিলাম।
-ভালোমত প্রসেসিং করবা।
-আরে এইগুলা কওন লাগে নাকি!
ওরা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আমার মাংসগুলো কেটে ফেলে অত্যাধুনিক করাত দিয়ে। ইলেক্ট্রনিক করাতের ধারালো স্পর্শে আমার মাংসগুলা খসে পড়ে সুবিন্যস্তভাবে। একটা ট্রেতে জমা করে তারা অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয় সেগুলো। সুচারূভাবে মাংস কাটা সম্পন্ন হলে তারা শূন্যস্থানে সবজি ভরে দেয়। শীতকালের টাটকা সবজী। টমেটো, বাঁধাকপি ইত্যাদি। কারো কারো কাছে মাংসের চেয়ে কম লোভনীয় নয়!
-আমার হাড়গুলো অক্ষত রাখেন অন্তত!
আমি অনুনয় করি।
-নিচ্চই! হাড় সব ঠিক থাকবে শুধু এক জায়গারটা বাদে।
আমি আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখি আমার পিঠের হাড় চূর্ণ করছে তারা। আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারবো না! মেরুদন্ড নিমিশেই বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রতিস্থাপনযোগ্য কোনকিছুও দেয় না সেখানে। একটা ল্যাগব্যাগে আকৃতি পাই আমি, প্যাকেট করে দেয়ার জন্যে খুব সুবিধে!
-হইছে না বস?
-আরে দারুণ হইছে! ভাঁজ কইরা প্যাকেট কইরা দাও ঠিকমতন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোনে অর্ডার পেয়ে তারা আমাকে তাদের অভীষ্ঠ জায়গায় পৌঁছে দেয়ার যোগারযন্ত্র করে।
*
দীর্ঘভ্রমণ শেষে রাতের বেলা আমি আমাকে খুঁজে পাই একটা আবদ্ধ কাঠের বাক্সে। আমার নিজের আলমিরার গঠনরীতির সাথে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাই জায়গাটার। জানি না কার আলমিরায় বন্দী আমি। একটা নারীকন্ঠ খিলখিলিয়ে হেসে আমাকে নেড়েচেড়ে যায়। উল্টেপাল্টে দেখে।
আর আমি শুনি কিছু ফিসফাস এবং শীৎকার।
দীর্ঘরাত শেষ হয় একসময়। সেই পরিচিত নারীকন্ঠ কাকে যেন বলছে,
-ব্রেকফার্স্ট রেডি স্যার!
-হু! আজকের মেন্যু কী?
-ভেজিটেবল!
-স্বাদ পরিবর্তনের জন্যে ভেজিটেবল মন্দ না। নিয়ে এসো।
-অলওয়েজ এ্যাট ইয়োর সার্ভিস, স্যার!
-এরকম স্যার স্যার করনা তো! বি ফ্র্যাঙ্ক হানি!
-ওক্কেই হানিই। নো প্রোবলেমো!
সেই টেনে টেনে বলা মেলোডি।
দুটো কন্ঠই আমার পরিচিত। একটা কোমল হাত আমাকে খুব সাবধানে তুলে নিয়ে যায় কিচেনে, ব্রেকফার্স্ট প্রস্তুত করবে বলে...

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মৃতবৎসা জোছনার কাল

তোমার জন্যে শুভ্র গোলাপ, বেড়ালতমা -হামিম কামাল