রিভার্সি/ওথেলো

তারা দুইজন। সময় কাটানোর জন্যে, অথবা বলা যায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্যে সারাদিন রিভার্সি খেলে। বুদ্ধিমত্তা এবং গাণিতিক গণনার কৌশলের কুশলী প্রয়োগে কে কার থেকে এগিয়ে বলা মুশকিল। তবে জয়-পরাজয় যাই আসুক তারা সহজভাবেই নেয়। তারা দুইজন, পাশাপাশি রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সেটা কতদিন, জিজ্ঞেস করলে তাদের ক্ষুরধার গাণিতিক জ্ঞানও বিব্রত হবে। তাদের কর্মপন্থা এবং দর্শন সম্পূর্ণই ভিন্ন। এতটাই ভিন্ন, যা তাদের এতদিনকার সহাবস্থানকে প্রশ্নের সম্মুখীন না করে পারে না। কারও জিজ্ঞাসার জবাব তারা দেয় না, হয়তোবা পৌঁছেও না তাদের কাছে। যদি পৌঁছাতো, একটা গতানুগতিক উত্তরই পাওয়া যেত হয়তোবা,
"আমাদের কর্মপদ্ধতি এবং দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও একে অপরের কাজকে শ্রদ্ধা করি। যার যা কাজ তা সূচারুভাবে পালন করাটাই তো সুবিবেচনার পরিচায়ক, তাই না?"
আর যদি প্রশ্নের ধরণ পাল্টে একটু জটিলতার দিকে যায়, যা তাদের মধ্যে সাংঘর্ষিক কোন অবস্থা তৈরি করতে পারে, যেমন, "আপনারা কি পরস্পরকে প্রতিদ্বন্দ্বীর দৃষ্টিতে দেখেন? বিপরীত ধারার কাজ বলে আপনাদের একজনের সাফল্য অন্যজনের ব্যর্থতার সমানুপাতিক হবার কথা। সেক্ষেত্রে..."
সেক্ষেত্রে তারা না শোনার ভান করে রিভার্সি বোর্ডে বসে যাবে সাদা কালো গুটিগুলো নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে, এই খেলাটাই তাদের কাজ!
রিভার্সি অথবা ওথেলো
রিভার্সি (ওথেলো নামেও পরিচিত) একটি বোর্ড গেম। এতে ৬৪ টি বর্গাকৃতির ঘর থাকে। দু পক্ষের মধ্যে খেলা হয় সাদা এবং কালো গুটি দিয়ে। খেলার শুরুতে দুটি সাদা এবং দুটি কালো গুটি বোর্ডের মাঝখানে সন্নিহিত থাকে। এরপর চাল দেয়া শুরু হয়। কাজ একটাই, তা হল, স্যান্ডউইচ বানানো! পাশাপাশি, কোনাকুনি, বা ওপর নীচে সাদা চাইবে সব কালোগুলিকে সাদা বানিয়ে ফেলতে এবং ভাইস ভার্সা!
উদাহরণ, ধরি সাদা হল ক এবং কালো হল খ। একদম শুরুতে বোর্ডের পজিশন থাকবে এমন,
ক ক
খ খ
এখন, প্রথম চাল যদি ক এর হয়, সে এমন অবস্থানে চাল দেবে যেন শুরুতে একটি ক এবং শেষে আরেকটি ক থাকে, মাঝখানের সবগুলো খ। এতে কী হবে? মাঝখানের খ গুলো ক হয়ে যাবে। অর্থাৎ কালোগুলি সাদা হবে। বেদনাগুলি আনন্দ হবে। কষ্টগুলি সুখ হবে!
এভাবে,
ক ক
খ ক

আনন্দ করুন! ৪ টি ক আর একটি মাত্র খ! অধিক আনন্দ, অল্প বেদনা। কিন্তু আনন্দ কি কখন চিরস্থায়ী হতে পারে! সুখের মত ক্ষণস্থায়ী বস্তু আর কী আছে? তাই কালো এখন এগিয়ে আসবে সাদাকে গ্রাস করতে। শুরুতে কালো, শেষে কালো, মধ্যবর্তী আলোগুলো বিলীন।
যেমন, কালোর চাল এখন এরকম হতে পারে,
ক ক
খ খ খ
ক এবং খ সমান। আনন্দ বেদনার সাম্যাবস্থা সবসময়ই কাঙ্খিত। কিন্তু আপনারা জানেন, খেলা এখনও শেষ হয়নি। মোট ৬৪ পয়েন্টের খেলা। একেক বোর্ডে একেক পক্ষ শক্তিশালী। কিন্তু অজস্র বোর্ডে খেলে চলেছে দুজনই! সেই কতদিন থেকে! প্রতিদিন নিযুত-কোটি বোর্ড খেলা হয় বলেই হয়তোবা তারা দুজন জয় পরাজয়ের ব্যাপারে এত নির্বিকার। আর এই জয় পরাজয় মোটেও তাদের ব্যক্তিগত না। তাদের খেলার ফলাফলের যথাযথ উদযাপনের জন্যে মানুষেরা সবসময়ই প্রস্তুত, অথবা অপ্রস্তুত অবস্থায়ও উদযাপনে বাধ্য!
একটি নির্দিষ্ট বোর্ডের কিছু খেলার ফলাফল
বোর্ড-১ সুমিতের তৃতীয় জন্মদিন/
কেক, মোমবাতি, উপহার, শুভাশীষ, সব মিলিয়ে আনন্দ/ সাদা জয়ী বিশাল ব্যবধানে। সবাই চলে যাবার উপক্রম করলে সুমিতের মন খারাপ হলে পরে বেদনা/ কালো কিছু পয়েন্ট করতে সক্ষম হয়েছিলো বটে, তবে তা নগণ্য, প্রকাশযোগ্য না!
বোর্ড-২ সুমিতের স্কুলে যাবার দিন/
নতুন স্কুলব্যাগ, নতুন জুতো, ঝলমলে স্কুল, সবুজ ঘাসের গালিচা, স্নেহময়ী শিক্ষিকা, সবমিলিয়ে আনন্দ বা সাদা গুটি এগিয়েছিলো বিস্তর। তবে কালো গুটি হিসেবে মা'র কথা মনে করে কান্নারা এলে খেলাটা বেশ জমে ওঠে। তবে ছুটির ঘন্টা এবং মা সাদা গুটি হিসেবে শেষ মুহূর্তে চলে এলে খেলাটা একপেশেই হয়ে যায়।
বোর্ড-৩ সপরিবারে প্রথম সমুদ্র যাত্রা/
এই খেলার ফলাফল বলাটা বাহুল্য হবে হয়তো ! এখানে পরিবারের সকলের সান্নিধ্যের উষ্ণতা, সমুদ্রের চঞ্চলতা সঞ্চালনকারী ঢেউ আর মন্দ্ররাগের গর্জন মিলে প্রবল প্রতাপে সাদা সাজিয়ে চলছিলো বোর্ডে। তবে রিভার্সি খেলার ধরণটা বড় অদ্ভুত। অনেকসময় দেখা যায়, ৫১-৩ পয়েন্টে এগিয়ে থাকা অবস্থায়ও সব গুটি প্রতিপক্ষের পেটে বিসর্জন দিতে হয়। প্রতিপক্ষ স্যান্ডউইচ বানিয়ে গোগ্রাসে খায় আয়েস করে। শেষ পর্যন্ত ৫১-৩ থেকে স্কোর হয়ে যায়, ২-৬২! সুমিত যদি সমুদ্রের লুকিয়ে থাকা চোরাবালিতে ডুবে যেত তাহলে স্কোরটা এমনই হত। বাবা আর মা দুই নির্বোধ সাদাগুটি হয়ে বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী একটা অপমানজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। ভাগ্যিস সেরকম কিছু হয়নি! ওদের সাথে আসা কাজের মেয়েটাও অবশ্য ডুবে যেতে পারতো চোরাবালিতে। তবে সে প্রসঙ্গ এখানে অপ্রসাঙ্গিক। তার অবস্থান হত অন্য কোন বোর্ডে। এই খেলায় মাত্র দুটি রঙের গুটি থাকবার নিয়ম আছে। সাদা আর কালো। আনন্দ আর বেদনা। সুখ আর কষ্ট। বিব্রতবোধ বা বিরক্তি নির্ণায়ক কোন গুটি এখানে নেই।
বোর্ড-৪ প্রত্যাখ্যাত হৃদয়ের বেদনা/
বেশ আয়োজন করেই এবং আত্মবিশ্বাস নিয়েই সুমিত তার সহপাঠিনী নিশুর প্রতি প্রেম নিবেদন করেছিল। আনন্দ এবং বেদনার গুটির যে বিভক্তিকর স্থূল সংযোজন আমরা পূর্বের বোর্ডগুলিতে দেখেছিলাম, যেমন আনন্দ/সুখ/সাদা নিয়ামক বস্তু- নতুন স্কুলব্যাগ, নতুন জুতো, ঝলমলে স্কুল, সবুজ ঘাসের গালিচা, স্নেহময়ী শিক্ষিকা, কেক, মোমবাতি, উপহার, শুভাশীষ এমন রকমারিতা এই বোর্ডে আসেনি। এখানে সাদা গুটি-ভালোবাসা। কালো গুটি- প্রত্যাখ্যান। অনেকদিন গুটি চালাচালির পরে শেষতক স্কোর সমান সমান হয়ে যায়। ৩২-৩২। বালকের কাছে এই সাম্যতার সান্ত্বনা অবশ্য প্রবঞ্চক পরাজয়ের সমতুল্যই ছিলো!
প্রাচীন দুই খেলুড়ের মধ্যে কথোপকথন
সাদা- জানিস, এই খেলাটা না খেললে পরে জানতামই না যে আমার এতগুলো রূপ আছে। খালিচোখে আমাকে যা দেখা যায় আদতে আমি শুধুই তা না!
কালো- আমিও। আচ্ছা তোর মনে আছে, একদম প্রথম জীবনে তোকে কি নামে ডাকা হত, বা কোন পরিচয়ে তুই সাচ্ছন্দ্য বোধ করতি?
সাদা-উমম... সুখ, আনন্দ। এই তো! সুখ+আনন্দ=সাদা। এগুলোকে ভাঙলে তেমন কিছু পাওয়া যেত ? ক্ষুধা, ঘুম, যৌনতার স্বাদ। ব্যাস! আর এখন...সাদা=সুখ+আনন্দ=আইফোন+এক্সট্যাসি+ভ্যালেন্টাইন কার্ড+রিলাক্সিন+গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট+ভালো মানের সার+ ভালো মানের পানির পাম্প+ইট-সুড়কির সুন্দর মিশ্রণ+সিনিপ্লেক্সে থ্রিডি মুভি+ ক্রিকেট খেলার টিকেট ইত্যাদি! বলে শেষ করা যাবে না।
কালো-হু। তেমনিভাবে আমার ক্ষেত্রে বেদনা আর দুঃখের সমার্থক শব্দও এখন তুই যেগুলি বললি সেগুলোকে ইনভার্স করলে যা যা হয় আর কী! হাহা!
সাদা- অবশ্য অতকিছু আমাদের জেনে হবেই বা কী! আমরা খেলে যাবো। কখনও জিতবো আমি, কখনও তুই! কিন্তু আসলে কি আমরা জিতি বা হারি? জেতে বা হারে তো অন্যরা। সুখী বা আনন্দিত, দুঃখী বা বেদনাতুর হয় তো অন্যরা। কেন খামোখা খেলছি, খেলেই যাচ্ছি বলতো!
কালো- ব্যাপারটাকে এভাবে দেখতে পারিস, আমাদের মৌলিক পরিচয়ে মানুষের অনুভূতি অনুরণিত হচ্ছে। তারা জীবনকে অভিশম্পাত করছে আমার কারণে, ধন্যবাদ জানাচ্ছে তোর কারণে। আমাদের ছাড়া তাদের উপায় কী!
সাদা- কিন্তু তারাই যদি না থাকতো, আমরা কোথায় থাকতাম? তাদের জন্যে আমরা, নাকি আমাদের জন্যে তারা?
কালো- অবশ্যই তাদের জন্যে আমরা। আর আমরা যে তাদের পরিচালিত করছি তা তো না! বরং তাদের কর্মকান্ডের জন্যেই গেমের চাল পরিবর্তিত হচ্ছে। এই যে এতগুলো গেম এত হাজার হাজার কোটি কোটি গেম খেলছি প্রতি মুহূর্তে, তুই কখনও খুব হিসেব করে খেলিস? আমি খেলি? না। র‌্যান্ডমলি চাল দিয়ে যাই। বোর্ড গুটিতে ভরে গেলে একটা স্কোরকার্ড আসে। সেটাতে কখনও তুই জিতিস, কখনও আমি। তাদের কার্যকালাপের একটা প্রতিলিপি থেকে যাচ্ছে বোর্ডে,আমরা সযতনে সাজিয়ে রাখছি, এইতো!
খেলার ফাঁকে ফাঁকে দীর্ঘ কথোপকথনের মাঝে তারা এই সিদ্ধান্তে আসে যে, প্রতিটি মানুষের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, যত খেলোই হোক না কেন, অতি বৃহৎ খেলার বোর্ডে সবই সংরক্ষিত হয়ে যায়। তবে এই অতি বৃহৎ খেলার বোর্ড কার তৈরি এবং এতে আরো কোন বোর্ডের সংযোগ আছে কী না তা তারা নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না।

রিভার্সি/ওথেলো খেলায় আধিপত্য বিস্তারের জন্যে কিছু টিপস:

*গুটিগুলো সবসময় বোর্ডের ধারে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
*বর্গাকৃতির বোর্ডে একদম কোণায় যে চারটি প্রান্ত আছে, সেগুলো দখল করা সবচে জরুরী। তাহলে ঐ গুটিগুলো কনস্ট্যান্ট হয়ে যাবে এবং অন্যপক্ষ স্যান্ডউইচ বানিয়ে সাবাড় করতে পারবে না। কারণ একদম প্রান্তসীমায় জাঁকিয়ে বসলে ওপর-নীচ-ডান-বাম সবখান থেকে আক্রমণ অকেজো হয়ে যায়।
সুতরাং,
সুখের দখল করতে চাইলে একাকীই থাকতে হবে! চারিপাশ থেকে কেউ যেন কোন বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। আপাতদৃষ্টিতে সুখী বা জয়ী ব্যক্তি হয়তোবা এমন নিঃসঙ্গ, অথবা এ্যাবসল্যুট সুখ বলে কিছু নেই! আছে জয়, উল্লাস, আনন্দ। কিন্তু সুখ? পরম সুখ এমনই মৌলিক এবং দুর্লভ একটি জিনিস যা অন্য কোন কিছুর সান্নিধ্যে এলে, সংস্পর্শ বেশিক্ষণ পেলে নষ্ট হয়ে যায়, ঠিক থাকেনা।

এবং নির্দিষ্ট সেই বোর্ডের বিশেষ একটি খেলার বিশদ ধারা বিবরণ
সুমিতের বয়স এখন ৪৫। তার সন্তানাদি নেই। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবার পর সে একাই থেকেছে। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনার অনুভূতিগুলো ক্রমশ ক্লিশে হয়ে যাচ্ছে। তেমন একটা দিন, আগের রাতে উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ খেতে ভুলে গিয়েছিলো সে। সারাদিন অস্বস্তিবোধের পর বিকেল বেলা মাথা ঝিমঝিম ভাবটা প্রবল হল। ঘাড়ের ব্যথাটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
ওদিকে তখন, বোর্ডে গুটি সাজানো হয়েছে।
সাদা (ঔষধ) সাদা (ডাক্তার)
কালো (অতি উচ্চরক্তচাপ) কালো (মৃত্যুভয়)
-নে চাল দে।
-দিলাম।
-হ্যালো! কে বনি? শরীরটা খুব খারাপ লাগছেরে।
-কেন সুমিত? কী হয়েছে?
-মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে। ঘাড়ে অসম্ভব ব্যথা।
-ও কিছু না। প্রেসারের ঔষধ খেয়ে একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুম দে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
বনির চেম্বারে সম্প্রতি কমবয়সী একজন মেয়ে আসছে নিয়মিত। তার ছাত্রী। চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক জরুরী আলোচনার জন্যে তারা কিছুক্ষণ কেবিনের দরজা বন্ধ করে রাখতেই পারে! ফোন বন্ধ রাখাটাও জরুরী এক্ষেত্রে। বনি ফোন বন্ধ করে দিল।
কালোর চাল প্রথমে,
কালো (অবহেলা)
সাদা (ঔষধ) কালো (অবহেলা)
কালো (অতি উচ্চরক্তচাপ) কালো (মৃত্যুভয়)
সুমিত ঘামছে প্রচন্ড। আর বোধ হয় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। অতি পরিচিত ওয়ার্ডরোবের ভেতর ওষুধগুলো সাজানো রয়েছে। এই অতি নির্ভরতার বস্তুগুলি সে অন্ধকারে হাতড়েই খুঁজে পেত এতদিন। কিন্তু আজকে বিশ্বাসঘাতক জমিন টলটলায়মান। কিছুতেই তাকে পৌঁছুতে দিচ্ছে না। অবশেষে সে অনেক কসরৎ করে ট্যাবলেটের প্যাকেটটা মুঠোস্থ করে পানি ছাড়াই গিলে ফেলল।
সাদার চাল,
কালো (অবহেলা)
সাদা (ঔষধ) সাদা (ঔষধ) সাদা (ঔষধ)
কালো (উচ্চরক্তচাপ) কালো (মৃত্যুভয়)
ট্যাবলেট খাবার পর কিছুটা ভালো বোধ করল সুমিত। তবে অবসন্নতা আর বিপন্নতা ছাপিয়ে তার ওপর চেপে বসল বহুকাল স্বজনবিবর্জিত থাকার অভিমান। নিজেকে অচ্ছ্যুত মনে হতে লাগলো তার।
কালোর চাল,
কালো (অবহেলা)
সাদা (ঔষধ) সাদা (ঔষধ) কালো (অচ্ছ্যুতভাব)
কালো (রক্তচাপ) কালো (ভয়) কালো (অবহেলা)
ঔষধের প্রভাবে অনেকটাই ভালো বোধ করছে সে এখন। একটা শাওয়ার নিয়ে ঘুমুতে গেলে শরীরটা পুরোপুরি ঝরঝরে লাগবে। জলের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে সকল অপবোধকে দূর করতে চাইছে সে। জলের চেয়ে প্রশান্তিময় আর কী আছে!
সাদার চাল,
কালো (অবহেলা)
সাদা (ঔষধ) সাদা (ঔষধ) কালো (অচ্ছ্যুতভাব)
সাদা (স্নান) কালো (ভয়) কালো (অবহেলা)
সাদা (স্নান)
একটুখানি তন্দ্রামত এসেছে, একটু ঘুমঘুমভাব। অবসাদ, অভিমান এবং আতঙ্ককে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণের অভিপ্রায়, একটু শান্তি, না হলেও কিছুটা স্বস্তিতো তার দরকার! দুঃস্বপ্নের আগ্রাসনে ঘুমের আশ্রয়ে লুকোনো স্বস্তি ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে আবারও তার ভয় ভয় লাগে। দমবন্ধ লাগে।
কালোর চাল,
কালো (অবহেলা)
কালো (দুঃস্বপ্ন) সাদা (ঔষধ) কালো (অচ্ছ্যুতভাব)
কালো (দুঃস্বপ্ন) কালো (ভয়) কালো (অবহেলা)
কালো (দুঃস্বপ্ন)
কালো (দুঃস্বপ্ন)
বিছানার পাশে এক বোতল পানি সবসময়ই রাখে সে। লালাগ্রন্থির রোগে আক্রান্ত হবার ফলে মাঝেমধ্যেই ভীষণ শুকিয়ে যায় গলা। আর দুঃস্বপ্নের আগ্রাসন, এমনটা তো নিয়মিত ব্যাপার! সেই সময়টায় তৃষ্ণা পায় খুব। তার রুটিনবাঁধা দুঃস্বপ্ন হল মৃত্যুর ডাক, কেউ একজন যেন গলায় শেকল বেঁধে পেচাতে থাকে আর হাসে নীরবে। বেশিরভাগ সময় সেইজন তার সাবেক প্রিয় কেউ'ই হয়! আজকে যেমন ছিল তার প্রিয় বন্ধু, বনি। দুঃস্বপ্নটা ভেঙে যাবার পরে ঢোকঢোক করে বোতল থেকে পানি গেলে সে।
সাদার চাল,
কালো (অবহেলা)
কালো (দুঃস্বপ্ন) সাদা (ঔষধ) কালো (অচ্ছ্যুতভাব)
কালো (দুঃস্বপ্ন) সাদা (জল) কালো (অবহেলা)
কালো (দুঃস্বপ্ন) সাদা (জল)
কালো (দুঃস্বপ্ন)
সর্বশেষ স্কোর, কালো-৭ সাদা ৩
আরো চুয়ান্ন রাউন্ডের খেলা বাকি। তবে আজ রাতের জন্যে সাদা এবং কালোর পক্ষের খেলোয়াড়েরা মূলত এই। অবহেলা, ঔষধ, ডাক্তার, জলস্নান, দুঃস্বপ্ন, জলপান, আতঙ্ক, অচ্ছ্যুতভাব। নতুন কিছু আর আসবে না। অন্তত আজ রাতে না। সাদাগুলো কালো হবে। কালোগুলো সাদা। হয়তোবা রাতের চাদরেই অনুভূতিগুলো সভয়ে গুঁটিসুটি মেরে থাকবে, অথবা ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় হেসে উঠবে। তবে এসব কিছুই পরিচালিত হবে এই গুটিকয়েক সাদা-কালো নির্ণায়ক দ্বারাই। বয়সের সাথে সাথে রিভার্সি/ওথেলো গেমের নিয়ম পাল্টায় না, সাদা কালো গুটিও পাল্টায় না, শুধু সাদা কালো গুটির অনুষঙ্গগুলো বাড়তে থাকে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে, সময়ের চৌখুপীতে অবসাদজীবন কাটাতে গিয়ে ভাড়া বাকি পড়লে অনুভূতি এবং অনুষঙ্গগুলো বেচে দিয়ে বেঁচে থাকা শিখতে হয়। আর তখন এসব সীমিত অনুভব দিয়ে সাদা আর কালো গুটিগুলোকে আনন্দ আর বেদনার পরিবর্তে জীবন আর মৃত্যুর প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। খেলাটা খুব একটু জমে না। কেউ কেয়ার ও করেনা এর ফলাফল নিয়ে।
*
খেলুড়ে দুজন বাকি ৫৪ রাউন্ড শেষে সযত্নে স্কোর তুলে রাখে মহাকালের পাতায়। আনন্দ-বেদনার চেয়ে জীবন-মৃত্যু অধিকতর গাঢ় অনুভব/অনুষঙ্গ হওয়াতে খেলা শেষ করে তারা হয়তোবা কিছুটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করে।

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মৃতবৎসা জোছনার কাল

তোমার জন্যে শুভ্র গোলাপ, বেড়ালতমা -হামিম কামাল