মরা মাছের চোখ যায় যদ্দুরে
লালকুঠির মাছের বাজারটা খুব একটু জমজমাট না। বিক্রেতারা বেশিরভাগ সময় মাছ বিক্রয়ের চেয়ে মাছি তাড়াতেই ব্যস্ত থাকে। বড় মাছ তেমন একটা আনে না কেউ এখানে কেনার মানুষ নেই বলে। তবে এক নাম্বারের বিশাল মাছবাজার থেকে কিনে ভুলক্রমে কেটে না নিয়ে বাসায় গেলে অনেকসময় গৃহকত্রী কর্তৃক ধিক্কৃত হয়ে লালকুঠির এই ছোট্ট মৎসপসরায় আসতে হয় কাউকে কাউকে। বিশাল একটা বটি নিয়ে মাছ কাটার দায়িত্বে রয়েছে ষাটোর্ধ ইদ্রিস আলি। মাছ কাটা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য কাজ। ইদ্রিস আলির শরীর এখনও পোক্ত আছে বলেই কাজটা করতে পারে। দিনে দশ-বারোটা রুই-কাতল-কালবাউশ কাটা সোজা কথা না। বিড়ি সিগারেট টানার অভ্যেস ইদ্রিস মিয়ার নেই। তার মুখে মাঝেমধ্যে কড়া জর্দা সহ পান গুঁজে দেয়ার দায়িত্ব ভাতিজা রকেটের। রক্তাক্ত হাত দিয়ে পান মুখে দিতে গেলে গলার ভেতরে রক্ত চলে যাবার সম্ভাবনা আছে।
গলায় রক্ত তুলে চিৎকার করে চলেছে আসমা।
-এত বড় মাছ আমি কাটবো কীভাবে? তোমার মাথায় কি একটুও বুদ্ধি নাই? মাছটা কাটায় আনলা না কেন? আমার এমনি কোমর ব্যথা! সেটা নিয়ে অবশ্য তোমার মাথাব্যথা থাকার কথা না। তুমি তো খালি জানো খাইতে!
-আস্তে চিল্লাও। কোমর ব্যথা নিয়ে যেরকম তড়পাইতাছো, হাঙ্গরমাছেও তো তা করবে না, আর আমি তো নিয়া আসছি নিরীহ রুইমাছ।
-রুইমাছরে মাছ লাগে না, না? আর আমারেও তো তোমার মানুষ লাগে না।
-ছি এইসব কী কউ! মানুষ বাদে কোন প্রাণীর ক্ষমতা আছে এমন ইরিটেটিং হওয়ার? আচ্ছা আমি যাইতাছি লালকুঠির বাজারে। কাটায়া নিয়া আসতাছি মাছটা। এখন থামো দয়া কইরা।
গজগজ করতে করতে শাহীন বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রওনা হয়।
-পেটি আর গাদা ঠিকমত আলাদা কইরা আনবা। আর মাথাটাও কাটায়া আনবা।
সমাধান পছন্দ হওয়ায় আসমা শাহীনের কথার শ্লেষটা গায়ে মাখে না।
-এত বড় মাছ আমি কাটবো কীভাবে? তোমার মাথায় কি একটুও বুদ্ধি নাই? মাছটা কাটায় আনলা না কেন? আমার এমনি কোমর ব্যথা! সেটা নিয়ে অবশ্য তোমার মাথাব্যথা থাকার কথা না। তুমি তো খালি জানো খাইতে!
-আস্তে চিল্লাও। কোমর ব্যথা নিয়ে যেরকম তড়পাইতাছো, হাঙ্গরমাছেও তো তা করবে না, আর আমি তো নিয়া আসছি নিরীহ রুইমাছ।
-রুইমাছরে মাছ লাগে না, না? আর আমারেও তো তোমার মানুষ লাগে না।
-ছি এইসব কী কউ! মানুষ বাদে কোন প্রাণীর ক্ষমতা আছে এমন ইরিটেটিং হওয়ার? আচ্ছা আমি যাইতাছি লালকুঠির বাজারে। কাটায়া নিয়া আসতাছি মাছটা। এখন থামো দয়া কইরা।
গজগজ করতে করতে শাহীন বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে রওনা হয়।
-পেটি আর গাদা ঠিকমত আলাদা কইরা আনবা। আর মাথাটাও কাটায়া আনবা।
সমাধান পছন্দ হওয়ায় আসমা শাহীনের কথার শ্লেষটা গায়ে মাখে না।
আজ ইদ্রিস আলির অনেক ব্যস্ততা। তিনটা কাতল মাছ দিয়ে গেছে একজন। আরো একজন দুটো রুইমাছ নিয়ে অপেক্ষমান।
-চাচা কতক্ষণ লাগবো আপনার?
-এইতো শুরু করলাম কেবল।
মাছের মাথাটা ফটাস করে ফাটিয়ে দিয়ে আঁশগুলো কুটতে থাকে সে। শাহীনের গা একটু শিউরে ওঠে মাছ কাটার এই নির্মম প্রক্রিয়া দেখে। অবশ্য মৃতমাছের সেসব অনুভূত হবার কথা না। কিন্তু মাছের মাথা এভাবে শরীরের জোর প্রয়োগ করে ফাটিয়ে ততোধিক জোর দিয়ে কোটাকুটির প্রক্রিয়াটা সে সামনে থেকে কখনও দেখে নি। তার ধারণা ছিলো মাছের শরীর অনেক নরম। মাংস সেদ্ধ হওয়া নিয়ে সে ঝামেলা হতে দেখেছে, শক্ত মাংস ছিড়তে না পেরে আসমার সাথে রাগারাগিও করেছে, মাছ নিয়ে কখনও এমন হয় নি। মাছের শরীরের কাঠিন্য সম্পর্কিত এই দুর্লভ জ্ঞান অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হত তাকে আজকে হঠাৎ বাজার করতে না এলে, শাহীন ভাবলো। তবে এই জ্ঞান কোন কাজে আসবে কী না সে বুঝতে পারছে না। কাজে না আসারই কথা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, আজকে তাদের বাসায় আশ্রিত ছেলেটা, যে বাজারবিষয়ক কর্মকান্ড তদারক করে, সে অসুস্থজনিত কারণে ছুটিতে না থাকলে শাহীনকে বাজারে আসতে হত না, আর কাজের মেয়েটা অনুপস্থিত না থাকলে আসমাও মাছ কাটা নিয়ে এত গ্যাঞ্জাম করতো না। বাজার করার এবং মাছ কাটতে নিয়ে যাবার খন্ডকালীন অভিজ্ঞতা থেকে লদ্ধ জ্ঞান শাহীনকে ঋদ্ধ করবে না নিশ্চয়ই! মাছের শরীর শক্ত হোক বা না হোক তাতে কিছুই এসে যায় না।
-চাচা কতক্ষণ লাগবো আপনার?
-এইতো শুরু করলাম কেবল।
মাছের মাথাটা ফটাস করে ফাটিয়ে দিয়ে আঁশগুলো কুটতে থাকে সে। শাহীনের গা একটু শিউরে ওঠে মাছ কাটার এই নির্মম প্রক্রিয়া দেখে। অবশ্য মৃতমাছের সেসব অনুভূত হবার কথা না। কিন্তু মাছের মাথা এভাবে শরীরের জোর প্রয়োগ করে ফাটিয়ে ততোধিক জোর দিয়ে কোটাকুটির প্রক্রিয়াটা সে সামনে থেকে কখনও দেখে নি। তার ধারণা ছিলো মাছের শরীর অনেক নরম। মাংস সেদ্ধ হওয়া নিয়ে সে ঝামেলা হতে দেখেছে, শক্ত মাংস ছিড়তে না পেরে আসমার সাথে রাগারাগিও করেছে, মাছ নিয়ে কখনও এমন হয় নি। মাছের শরীরের কাঠিন্য সম্পর্কিত এই দুর্লভ জ্ঞান অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হত তাকে আজকে হঠাৎ বাজার করতে না এলে, শাহীন ভাবলো। তবে এই জ্ঞান কোন কাজে আসবে কী না সে বুঝতে পারছে না। কাজে না আসারই কথা। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, আজকে তাদের বাসায় আশ্রিত ছেলেটা, যে বাজারবিষয়ক কর্মকান্ড তদারক করে, সে অসুস্থজনিত কারণে ছুটিতে না থাকলে শাহীনকে বাজারে আসতে হত না, আর কাজের মেয়েটা অনুপস্থিত না থাকলে আসমাও মাছ কাটা নিয়ে এত গ্যাঞ্জাম করতো না। বাজার করার এবং মাছ কাটতে নিয়ে যাবার খন্ডকালীন অভিজ্ঞতা থেকে লদ্ধ জ্ঞান শাহীনকে ঋদ্ধ করবে না নিশ্চয়ই! মাছের শরীর শক্ত হোক বা না হোক তাতে কিছুই এসে যায় না।
আসমার কোমড়ে একটা মাংসপিণ্ড শক্ত হয়ে গিট্টু পাকিয়ে আছে। প্রচন্ড ব্যাথা। ডাক্তার দেখায় নি এখনও। সময় কই? শাহীনকেও কিছু জানায় নি। অবশ্য জানালেই যে সে শশব্যস্ত হয়ে ডাক্তার-ঔষুধ নিয়ে পাড়াপাড়ি শুরু করবে তা না। সত্যি কথা বলতে কী, সেরকমটা হলে আসমা একটু বিরক্তই হত। কার কোমড়ে কোথায় পুঁটুলি গজিয়েছে এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। অন্য কাউকে এটা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। অনেককিছু নিয়েই তো তারা ভাবে না এখন আর। একটা সন্তুোষজনক বৈবাহিক যৌনজীবন পার করে আসার পর রাতের বেলা অর্ধাঙ্গীর সঙ্গমেচ্ছা জাগলে তার শরীর শক্ত হয়ে থাকলেও সে কোন অভিযোগ করে না আর, কোমড়ের শক্ত মাংসপিণ্ডটা নিয়েও সে ভাববে না এটাই স্বাভাবিক। আসমার শরীর যথেষ্ট স্থূল হয়েছে গত দশ বছরে, তারপরেও এখনও তাকে বড়জোর পৃথুলা বলা যায়। স্থূলতা তার সৌন্দর্যহানি ঘটায় নি সেভাবে। ঘটালেও কিছু এসে যেতো না। সারাদিন ঘরের মধ্যে থেকে রান্নাবান্না, বাসার তদারকি, এবং উঁচুগলায় চিৎকার করার জন্যে সৌন্দর্যের দরকার পড়ে না। দরকার গলার জোর এবং সাচ্ছন্দ্য চলাফেরার ক্ষমতা।
শাহীন মাছ কাটার সিরিয়ালে নিজের মাছকে মৌখিকভাবে নিবন্ধিত করে বাজারটা ঘুরতে বেরুলো। মেছোবাজারে অবশ্য দেখার কিছু নেই। তাও আবার এরকম ছোট বাজার, যেখানে আঁশটে গন্ধটা পর্যন্ত সেভাবে পাওয়া যায় না। কিছু খাবি খাওয়া কই মাছ, চেপ্টে থাকা বাতাসি মাছ আর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা শোলমাছ দেখার মাধ্যমে তার বাজার পরিভ্রমণ শেষ হল।
-কদ্দুর চাচা?
-এইতো আপনেরটা শুরু করলাম। ভালা মাছ কিনছেন। স্বাদ হইবো।
স্বাদ হবে সেটা অবশ্য জানা কথা। আসমার রান্না নেহায়েৎ মন্দ না। কখন যে এই মাছগুলো বাজার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ভায়া ফ্রাইং প্যান প্লেটে জায়গা করে নেবে!
-পেটি আর গাঁদা আলাদা করুম? মাথাটা কি আস্ত রাখুম নাকি ভাগ কইরা দিমু?
আসমা কী যেন বলেছিলো? ঝগড়াঝাটি ছাড়া আর কীরকম কথোপকথন হয়েছিলো যেন তাদের? ধুর! মনে পড়ে না শাহীনের।
-যেমনে ভালো হবে তেমনে দেন। যন্ত্রণা আর ভাল্লাগে না!
-কদ্দুর চাচা?
-এইতো আপনেরটা শুরু করলাম। ভালা মাছ কিনছেন। স্বাদ হইবো।
স্বাদ হবে সেটা অবশ্য জানা কথা। আসমার রান্না নেহায়েৎ মন্দ না। কখন যে এই মাছগুলো বাজার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ভায়া ফ্রাইং প্যান প্লেটে জায়গা করে নেবে!
-পেটি আর গাঁদা আলাদা করুম? মাথাটা কি আস্ত রাখুম নাকি ভাগ কইরা দিমু?
আসমা কী যেন বলেছিলো? ঝগড়াঝাটি ছাড়া আর কীরকম কথোপকথন হয়েছিলো যেন তাদের? ধুর! মনে পড়ে না শাহীনের।
-যেমনে ভালো হবে তেমনে দেন। যন্ত্রণা আর ভাল্লাগে না!
কোমরের ব্যথাটা বেশ যন্ত্রণা দিচ্ছে। একটা পেইনকিলার খাওয়া দরকার, আসমা ভাবে। তবে খালি পেটে পেইনকিলার খাওয়া ঠিক না। শাহীন এখনও মাছটা নিয়ে আসছে না কেন? মাছটা নিয়ে এলে রান্না করে একেবারে বিশ্রাম নেবে আজকের মত সে। বিকেলে ডাক্তারের কাছেও যেতে পারে। আসমা মাছের নানারকম পদ জানে। দাম্পত্য জীবনের প্রথম বছরে পারস্পরিক মুগ্ধতাকরণ প্রতিযোগিতায় জিততে যেসব রেসিপি শিখেছিলো সেগুলো তখন রোমান্সের ক্ষেত্রে প্রভাবক হলেও এখন দৈনন্দিন জীবনের অত্যাবশ্যক অনুষঙ্গ হিসেবে কাজে লাগছে। আসমা নানারকম রাঁধতে ভালোবাসে। শাহীনেরও খুব খাইখাই স্বভাব। খেতে দিতে একটু দেরী হলেই রাগারাগি করবে। তার অবশ্য ধৈর্য্য বরাবরই কম। সব ব্যাপারেই।
-চাচা আর কতক্ষণ লাগবো? পানটা পরে চিবান না। মাছটা তাড়াতাড়ি সাইজ করেন।
ইদ্রিস আলি কাজের সময় বাগড়া দেয়া পছন্দ করে না। পান চিবুনোটা তার মাছ কর্তন বিষয়ক কার্যক্রমেরই একটা অংশ। সে বিরক্ত হয়ে পানের পিক ফেলে শাহীনের দিকে তাকায়, চোখের দৃষ্টি দিয়ে বলে দেয় যে পানটা ঠিকমত না চিবিয়ে সে কাজে হাত দিচ্ছে না।
ইদ্রিস আলি কাজের সময় বাগড়া দেয়া পছন্দ করে না। পান চিবুনোটা তার মাছ কর্তন বিষয়ক কার্যক্রমেরই একটা অংশ। সে বিরক্ত হয়ে পানের পিক ফেলে শাহীনের দিকে তাকায়, চোখের দৃষ্টি দিয়ে বলে দেয় যে পানটা ঠিকমত না চিবিয়ে সে কাজে হাত দিচ্ছে না।
আসমার মনে পড়ে যে সে শাহীনকে মাছের চোখ সম্পর্কিত কোন নির্দেশনা দেয় নি। মুড়িঘন্টের একটা নতুন আইটেম বানাবে বলে ভেবেছিলো, মাছের চোখ ফেলে দিলে ওটার পুরো মজা পাওয়া যাবে না। ফোনটা কই গেল? ফোন করে বলে দেয়া দরকার যে মাছের চোখ যেন ফেলে না দেয়। অবশ্য এতক্ষণে হয়তোবা মাছ কাটা শেষ, বলে লাভ হবে মনে হয় না।
-নেন ঠিকঠাক মত সাইজ কইরা দিলাম। এখন বাসায় নিয়া যায়া আরাম কইরা খান।
-কত দিবো দুইটা মাছের জন্যে?
-ষাইট টাকা দেন।
-পাঁচশ টাকার নোটের ভাঙতি আছে?
-ভাঙতি নাই। কইরা আনেন।
-যন্ত্রণা!
ভাঙতির জন্যে কত দোকান ঘুরতে হয় কে জানে! এখানে সব ছোটখাট দোকান, অন্তত শখানেক টাকার কেনাকাটা না করলে ভাঙতি দেবে বলে মনে হয় না। শ'খানেক টাকা খরচ করতে তার সমস্যা নেই, কিন্তু কিনবে টা কী! সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, নাহলে এক প্যাকেট কেনা যেত। কোল্ড ড্রিংকস কিনে নিয়ে যাওয়া যায়। ভরপেট খাবার পরে কোল্ড ড্রিংকসটা জমবে ভালো। ঝাঁঝ হবে তো ভালো?
-কত দিবো দুইটা মাছের জন্যে?
-ষাইট টাকা দেন।
-পাঁচশ টাকার নোটের ভাঙতি আছে?
-ভাঙতি নাই। কইরা আনেন।
-যন্ত্রণা!
ভাঙতির জন্যে কত দোকান ঘুরতে হয় কে জানে! এখানে সব ছোটখাট দোকান, অন্তত শখানেক টাকার কেনাকাটা না করলে ভাঙতি দেবে বলে মনে হয় না। শ'খানেক টাকা খরচ করতে তার সমস্যা নেই, কিন্তু কিনবে টা কী! সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, নাহলে এক প্যাকেট কেনা যেত। কোল্ড ড্রিংকস কিনে নিয়ে যাওয়া যায়। ভরপেট খাবার পরে কোল্ড ড্রিংকসটা জমবে ভালো। ঝাঁঝ হবে তো ভালো?
ঝাঁঝ শব্দটা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেমন বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়! বাসায় আসমার ঝাঁঝে সে অতিষ্ঠ, আর এখানে বোতলের ভেতর থেকে সে চাচ্ছে প্রশান্তিকর ঝাঁঝ!
নাহ লোকটা বেশি বাড়াবাড়ি করা শুরু করেছে। একটা মাছ কুটে আনতে এতক্ষণ লাগে? ফোনটা কই গেলো?
-এই কোথায় তুমি? কোথায় যায়া আড্ডা মারতেছো? মাছ আনবা কখন আর আমি রানবো কখন?
শাহীন এক লিটারের কোকের বোতলের ছিপি খুলে গ্লাসে ঢেলেছে একটু, সেইসময় আসমার ফোন পেয়ে ফোঁসফোঁস করতে থাকা কোমল পানীয়র ফেনাগুলো যেন নিস্প্রভ হয়ে যায় কিছুটা। চুমুক দিয়ে যে প্রশান্তির ভাবটা এসেছিলো, আসমার কথা শুনে তা ছুটে যায় নিমিষেই।
-তোমার ধারণা আমি মাছের ব্যাগ হাতে নিয়া রং করতে বাইর হৈছি?
কোকের বোতল আর ভাঙতি টাকা নিয়ে দোকান থেকে বের হবার সময় সে তার বাক্যবাণ ছুড়তে থাকে অব্যাহত গতিতে,
-সবসময় তুমি ক্যাচক্যাচ করবাই। যেকোন কিছু নিয়া। এটা তোমার একটা ব্যাড হ্যাবিট হয়া গেছে।
ইদ্রিস আলির দোকানের সামনে আসার পর আসমা পাল্টা আঘাত হানে,
-মাছ কুটাইতে এতক্ষণ লাগাইছো, খাওনও দেরীতে পাইবা। তখন আবার প্যানপ্যান করবা না কইলাম!
-আরে আজব তো! সিরিয়াল ভাইঙা আমি কেমনে আমারটা আগে কাটামু? না বুইঝা চিল্লাও ক্যান?
-এই কোথায় তুমি? কোথায় যায়া আড্ডা মারতেছো? মাছ আনবা কখন আর আমি রানবো কখন?
শাহীন এক লিটারের কোকের বোতলের ছিপি খুলে গ্লাসে ঢেলেছে একটু, সেইসময় আসমার ফোন পেয়ে ফোঁসফোঁস করতে থাকা কোমল পানীয়র ফেনাগুলো যেন নিস্প্রভ হয়ে যায় কিছুটা। চুমুক দিয়ে যে প্রশান্তির ভাবটা এসেছিলো, আসমার কথা শুনে তা ছুটে যায় নিমিষেই।
-তোমার ধারণা আমি মাছের ব্যাগ হাতে নিয়া রং করতে বাইর হৈছি?
কোকের বোতল আর ভাঙতি টাকা নিয়ে দোকান থেকে বের হবার সময় সে তার বাক্যবাণ ছুড়তে থাকে অব্যাহত গতিতে,
-সবসময় তুমি ক্যাচক্যাচ করবাই। যেকোন কিছু নিয়া। এটা তোমার একটা ব্যাড হ্যাবিট হয়া গেছে।
ইদ্রিস আলির দোকানের সামনে আসার পর আসমা পাল্টা আঘাত হানে,
-মাছ কুটাইতে এতক্ষণ লাগাইছো, খাওনও দেরীতে পাইবা। তখন আবার প্যানপ্যান করবা না কইলাম!
-আরে আজব তো! সিরিয়াল ভাইঙা আমি কেমনে আমারটা আগে কাটামু? না বুইঝা চিল্লাও ক্যান?
ইদ্রিস আলি বেশ আগ্রহ নিয়ে উপভোগ করতে থাকে তাদের রাগোপকথন। মাছ কাটার পরিশ্রমসাধ্য কাজের ফাঁকে এটা তার কাছে বেশ একটা বিনোদন হিসেবে আসে।
-ভাঙতি আনছি চাচা, দিয়া দেন ব্যাগে কইরা।
বাকবিতন্ডা শেষে শাহীন অবশেষে যখন ব্যাপারটার একটা শান্তিপূর্ণ রফা করতে যাচ্ছে তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে জবুথবু হয়ে দোকানের এক কোণে দাঁড়িয়ে সে হতাশ চোখে কর্দমাক্ত বাজারের রাস্তার দিকে তাকায়। এই বৃষ্টিতে বেরুলে ভিজতে তো হবেই, কাপড়ও নষ্ট হবে।
-যেমন মেঘ করছে, বৃষ্টিটা সহজে থামবে বইলা মনে হয় না। এইখানেই খাড়ায় থাকেন। কমলে যাইয়েন।
-ভাঙতি আনছি চাচা, দিয়া দেন ব্যাগে কইরা।
বাকবিতন্ডা শেষে শাহীন অবশেষে যখন ব্যাপারটার একটা শান্তিপূর্ণ রফা করতে যাচ্ছে তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। ব্যাগটা হাতে নিয়ে জবুথবু হয়ে দোকানের এক কোণে দাঁড়িয়ে সে হতাশ চোখে কর্দমাক্ত বাজারের রাস্তার দিকে তাকায়। এই বৃষ্টিতে বেরুলে ভিজতে তো হবেই, কাপড়ও নষ্ট হবে।
-যেমন মেঘ করছে, বৃষ্টিটা সহজে থামবে বইলা মনে হয় না। এইখানেই খাড়ায় থাকেন। কমলে যাইয়েন।
ইদ্রিস আলি কথাগুলো বলে নতুন কাজে হাত দেয়। মৃত শোলমাছ সাধারণত কেনে না মানুষ। এই লালকুঠির বাজারে অবশ্য এটারই কদর বেশি। তাজা শোলমাছ কেনার লোক নেই। তাই বিক্রেতারা আনেও না। গতকালের বৃষ্টিতে নর্দমায় ভাসতে দেখে গফুর মিয়া নিয়ে এসেছিলো দুটো তাজা শোলমাছ। তবে তা বিকোয় নি। আজকে সে দুটো মারা যাবার পরে কিনে নিলো একজন। সাধারণত এখান থেকে যারা মাছ কেনে, তারা মাছ কোটার জন্যে বাড়তি পয়সা খরচ করে না। আজকে ইদ্রিস আলির ভাগ্য ভালো। তবে শোলমাছগুলোর শরীর বেশি শক্ত। কাটতে বেশ কষ্ট হবে।
আসমার কষ্ট হচ্ছে। বেশ কষ্ট হচ্ছে। এতটাই, যে অসময়ে বৃষ্টির আগমনে মাছ নিয়ে শাহীনের আসতে বিলম্বের প্রতিক্রিয়ার রান্নাবান্না করতে দেরী হবে এই কারণে সে বৃষ্টি অথবা শাহীন অথবা রুইমাছ কারো ওপরেই রেগে গালমন্দ করতে পারছে না। কোমড়ের কাছে মাংসের পুঁটলিটা শক্ত হয়ে বেশ পেইন দিচ্ছে।
খালিপেটে পেইনকিলার খাওয়া ঠিক না।
শাহীন আসবে কখন? হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটা থামবে কখন? শাহীন এলে...
সে রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে পেইনকিলার খেতে পারে। খালি পেটে পেইনকিলার খাওয়া ঠিক না...
শোলমাছগুলো এখনও জীবিত আছে মনে হচ্ছে। শরীর একটু কাঁপলো নাকি?
-ও চাচা! শোলমাছগুলা কি বাঁইচা আছে? নড়ে কেন? কষ্ট পাইতাছে তো!
বৃষ্টির প্রবল দমকে কথাগুলো ঠিকমত পৌঁছোয় না ইদ্রিস আলির কাছে। সে অস্পষ্টভাবে শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় শাহীনের দিকে। অনুধাবন করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে আবার মাছ কাটায় মন দেয়।
-ও চাচা! শোলমাছগুলা কি বাঁইচা আছে? নড়ে কেন? কষ্ট পাইতাছে তো!
বৃষ্টির প্রবল দমকে কথাগুলো ঠিকমত পৌঁছোয় না ইদ্রিস আলির কাছে। সে অস্পষ্টভাবে শুনতে পেয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় শাহীনের দিকে। অনুধাবন করার চেষ্টা ব্যর্থ হলে আবার মাছ কাটায় মন দেয়।
বৃষ্টিটা থামবে কখন? এই আঁশটে গন্ধময় রক্তাক্ত পরিবেশ আর ভালো লাগছে না শাহীনের। অবশ্য বাসায় গেলে আসমার ক্যানক্যানানি শুনতে হবে। তা হোক। বাসায় গেলে ইতিমধ্যেই শরীরে লেগে যাওয়া ছিটে ছিটে রক্ত আর কাদা পরিস্কার করা যাবে।
ইদ্রিস আলি একটা শোলমাছ কেটে টুকরো করছে নিপুন দক্ষতায়। তার ভাতিজা রকেট কোথায় যেন গেছে। এই বৃষ্টিতে তাকে আর পাওয়াও যাবে না। রক্ত লেগে জমে দাগ হয়ে যাওয়া হাতটাই কোনরকমে বৃষ্টির পানি দিয়ে পরিস্কার করে পানটা মুখে দিতে হবে। গলার ভেতর দুয়েক ফোঁটা রক্ত গেলে যাক। পান না চিবুলে তার হবে না।
আসমার কোমড়ের জড়ুলটা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। কেন যে খামোখাই টিপতে গিয়েছিলো! অনেকদিন পর কোমড়ের স্পর্শকাতর জায়গাটায় হাত দিতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলো যে ওটা আর আগের মত নেই। প্রথম স্পর্শের সেই শিহরণ এখন আর জাগে না। কিন্তু সেই শিহরণজনিত গতিজড়তা কখনও বিলীন হয় না। হঠাৎ রক্তপ্রবাহ ঝলকে যায় শিরার ভেতর দিয়ে। আজকের এই বৃষ্টিদুপুরটার দোষ। সে রাতেও বৃষ্টি ছিলো এরকম! সে যাকগে, এটুকু রক্ত কোন ব্যাপার না। ধমনীতে প্রবাহিত স্পর্শত্বরণিত রক্ত অথবা শক্ত হয়ে যাওয়া বিদঘুটে মাংসপিন্ডটা থেকে নিঃসৃত রক্ত...কিছু এসে যায় না। রাঁধতে হবে।
বৃষ্টিটা থেমে এসেছে। শাহীন এখন আসবে মাছ নিয়ে। তাকে বলতে ভুলে গেছে যেন মাছের চোখ যেন ফেলে না দেয়।
-আরে তুমি কখন বললা চোখ না ফালানোর কথা? ভুল আমার হইতাছে না, তোমার হইতাছে। তুমি বল নাই এই কথা। আর এখন বইলাও লাভ নাই। খাড়াও জিগায়া দেখি। চাচা, মাছের চোখ কী ফালায়া দিসেন?
-হ। ঐতো পইড়া আছে নিচে।
-ফালায়া দিসে। আর বইলা লাভ নাই। চোখ ছাড়াই মুড়িঘন্ট বানাও। রাখি।
-হ। ঐতো পইড়া আছে নিচে।
-ফালায়া দিসে। আর বইলা লাভ নাই। চোখ ছাড়াই মুড়িঘন্ট বানাও। রাখি।
ব্যাগটা নিয়ে আরো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কথা ভাবে শাহীন। এত বৃষ্টির পর রাস্তার অবস্থা যাচ্ছেতাই হয়েছে। বাসা অবশ্য বেশি দূরে না। হেঁটেই যাওয়া যায়। তবে তাতে পোষাকের অবস্থা যাচ্ছেতাই হবে। আসমার যা মেজাজ হয়েছে আজকাল, কোমর নিয়ে চলতে পারে না, রেগে ভূত হয়ে যাবে। রিকশা টিকশা নাই কোন? এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে শাহীনের অস্বস্তি লাগে। কিছু বলতে হয় বলে বলা, ইদ্রিস আলিকে সে আবারও প্রশ্নটা করে,
-চাচা, মাছের চোখ কি ফালায়া দিসেন?
শক্ত শোলমাছের শরীর কাটতে ব্যস্ত ইদ্রিস আলি কর্ণপাত করে না। শাহীন নিজেই নিচে তাকিয়ে দেখে মরা মাছের চোখ তার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। শাহীনের ভয় হয় কেন যেন।
-চাচা, মাছের চোখ কি ফালায়া দিসেন?
শক্ত শোলমাছের শরীর কাটতে ব্যস্ত ইদ্রিস আলি কর্ণপাত করে না। শাহীন নিজেই নিচে তাকিয়ে দেখে মরা মাছের চোখ তার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। শাহীনের ভয় হয় কেন যেন।
তার মনে হয় তাদের যাপিত জীবনের সংঘটিত সবকিছু বিদ্রুপের দৃষ্টিতে দেখছে মরা মাছের চোখ অথবা তাদের জীবনটাই একটা মাছের চোখের ভেতর বন্দী।
মরা মাছের চোখ যায় যদ্দুরে...
বৃষ্টি থেমে গেছে। আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। রোদের আদর গায়ে মেখে সে কর্দমাক্ত পথ মাড়িয়ে চলতে থাকে মরা মাছের চোখের দৃষ্টিসীমা থেকে দূরে সরে যেতে। যদিও সে জানে না সেটার পরিধি ঠিক কত! চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে প্রিয় গানের পরের লাইনটা মনে করতে থাকে,
শুকানো জলছবি আজো রোদ্দুরে...
তাড়াহুড়ো করে ফিরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে তার পা থেকে রক্ত বেরোয়। এটুকু রক্তে কিছু এসে যায় না। অনেক রক্ত দেখেছে সে।
হৃদয় থেকে উৎসারিত রক্ত
ধমনীতে রক্তস্প্রিন্ট
প্রথম মিলনের সুখকর ব্যথাতুর রক্তক্ষরণ
মরা মাছ...না!
হ্যাঁ... মরা মাছের শক্ত শরীর। ঠান্ডা রক্ত।
হ্যাঁ!
মরা চোখ... না!
সেদিন এরকম বৃষ্টি ছিলো...সেদিন সে কারো চোখে নিশীথ রাতের বাদলধারা দেখেছিলো...কোনদিন...কবে যেন?
আজ সে দেখলো মরা মাছের চোখ, তার বেঁধে দেয়া বাউন্ডারি।
হৃদয় থেকে উৎসারিত রক্ত
ধমনীতে রক্তস্প্রিন্ট
প্রথম মিলনের সুখকর ব্যথাতুর রক্তক্ষরণ
মরা মাছ...না!
হ্যাঁ... মরা মাছের শক্ত শরীর। ঠান্ডা রক্ত।
হ্যাঁ!
মরা চোখ... না!
সেদিন এরকম বৃষ্টি ছিলো...সেদিন সে কারো চোখে নিশীথ রাতের বাদলধারা দেখেছিলো...কোনদিন...কবে যেন?
আজ সে দেখলো মরা মাছের চোখ, তার বেঁধে দেয়া বাউন্ডারি।
শাহীন সভয়ে পেছনে তাকায় সেই চোখ এখনও তাকে অনুসরণ করছে কী না! তার হাঁটার গতি বাড়তে থাকে।
ব্যালকনি থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে যে নারীটি, তাকে অন্তত মরামাছের চোখের দৃষ্টিসীমা থেকে আড়াল করতে হবে। কোনখানে দাঁড়ালে সে আড়াল পাবে? শাহীন ব্যালকনি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঝগড়াটে আসমা এবং ধূর্ত মরা মাছের চোখের মধ্যবর্তী অবস্থান খুঁজতে যুঝতে থাকে।
বাসার কাছাকাছি এসেও সে পিছুতে থাকে। রোদকড়া পড়ে যায় তার ঘর্মাক্ত দেহে। অবশেষে যখন নিশ্চিত হয় যে, মৃতমাছের চোখ আর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটির মধ্যে সে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পেরেছে তখন সে, ওখানে দাঁড়িয়ে খুব হাত নাড়তে থাকে আসমার দিকে তাকিয়ে। আসমাও পাল্টা হাত নাড়ে।
এখন আরেকবার বৃষ্টি নামলেই হয়, সে এগুতে পারবে।
শাহীন ভাবে।
আসমা অপেক্ষা করে।
আসমা অপেক্ষা করে।
Comments
Post a Comment