বৈহাসিক বৈক্লব্য

বাসের ভেতর মানুষ বাড়ছে। যন্ত্রযানটির স্থিতিস্থাপক এবং স্ফিত পাকস্থলিতে দিব্যি এঁটে যাচ্ছে ঘামে ভেজা এঁটোঝুঁটো মানুষ, বডিস্প্রে দেয়া স্যুটেড বুটেড এটিকেটঅলা মানুষ। যানটি কুমিরের পরিপাকতন্ত্রের মত হজমক্ষমতা নিয়ে উদরস্থ করেছে সবাইকে। উগড়ে দিচ্ছে না কাউকে। ইঞ্জিন কাভারের ওপরে কোনমতে জায়গা করে নিয়ে ববির মধ্যে একটা প্রশান্তির অনুভূতি কাজ করে। যদিও জায়গাটি গরম, এবং বসতে হয়েছে বেশ কসরৎ করে, এবং বসার সময় পশ্চাদ্দেশে গরম খুন্তির মত ছ্যাক খেয়েছিলো, দুই পাশের দুই যাত্রী; একজন ডাকসাইটে যুবতী এবং একজন চিরবিরক্ত চেহারার প্রৌঢ়, তার আগমনকে সুস্পষ্ট বিরক্তি দিয়ে স্বাগতম জানিয়েছিলো। এসব প্রতিকূলতাকে মুরগীর পালকের মত হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত ববি। ভীড় ঠেলে বাসে ওঠা গেছে, তার ওপর আবার বসার একটা জায়গাও পাওয়া গেছে, আর কী চাইতে পারে ববি! আজিমপুর থেকে মিরপুর। কম দূরত্ব তো না!
কম মানুষের গন্তব্য না।
বাসের ভেতর মানুষ বাড়ছে। হয়তোবা দেখা হয়ে যাবে কোন চেনামুখের সাথে। হলে মন্দ হয় না। বসার জায়গা, সাথে ফ্রি আড্ডা- মূলত বসার জায়গা পাওয়া গেছে বলেই চেনা/অর্ধচেনা যে কারো সাথে আড্ডা দেবার এক ফুরফুরে আমেজ অনূভব করে ববি। তবে ইঞ্জিন কাভারে হেলান দেয়ার জায়গা নেই বলে বাধ্য হয়ে তাকে কুঁজো হয়ে বসে কন্ডাক্টরের সাথে যাত্রীদের বাসে মানুষ ওঠানো নিয়ে বিতন্ডাটা দেখতে হচ্ছিলো। কিছু করার নেই, তাই এই ঝগড়াটায় সে অংশগ্রহণ করবে কী না, এবং করলে কোন পক্ষে থাকবে এটা নিয়ে একটু দ্বন্দ্বে আছে ববি। দু পক্ষের জন্যেই যুক্তি আছে। এতগুলো মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে, ফলে কন্ডাক্টরের পক্ষ নিয়ে-
"আরে ভাই, থামেন! বাড়িতে তো সবাইরেই যাইতে হইবো। কষ্ট কইরা চাইপা যান!"
নাকি যাত্রীদের পক্ষ হয়ে,
"বাস ভইরা গেছে, তাও লোক উঠাইতাছো! ভাড়া কিন্তু হাফ দিমু!"
ববির পক্ষালম্বন বিষয়ক চিন্তাভাবনার সময় বচসাটা সামনের দিকে এগিয়ে গেলে হাঁফ ধরা শ্বাসকষ্টের রোগীর মত বাসটা থেমে থেমে চলতে থাকে আর ববিও ভাবনাটা থেকে নিস্কৃতি পায়। সায়েন্স ল্যাবের মোড়ে তার সামনে রড ধরে ঝুলতে থাকা মানুষটি নেমে গেলে ববি তার লম্বা পা গুলো একটু ছড়িয়ে বসতে গিয়ে খেয়াল করে, সামনের জানালার কাছে শুভ বসে আছে। চমৎকার ব্যাপার! শুভর সাথে ববির একসময় ভালোই দহরম মহরম ছিলো। এমন পয়মন্ত দিন সচরাচর আসে না। মাত্র মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে বাস পাওয়া গেছে, দুই মিনিটের ভেতর বসার জায়গা মিলেছে, মিনিট সাতেকের ভেতর একজন পরিচিত মানুষের দেখা পাওয়া গেল, যার সাথে দীর্ঘভ্রমণ পথে টুকটাক কূটকাচালি, অন্তরঙ্গ আলাপ অথবা দেশোদ্ধার যা ইচ্ছে তাই করা যাবে। সব কিছুই উন্মুক্ত।
-আরে শুভ যে! কই যাইতাছেন?
-কী খবর ববি! আমি শ্যামলী যাই। আপনে কই যান?
-এই তো, মিরপুরে।
-এহনও মিরপুরেই আছেন?
-হ! আপনের খবর টবর কী?
-চলতাছে আর কী! তয় একটা সুসংবাদ আছে আমার...
সুসংবাদ! সুসংবাদ! সুসংবাদ!
আজকে নীলক্ষেতের মোড়ে রিকশায় করে টেপরেকর্ডারে একটা সুসংবাদ বিলি করছিলো একজন। দাঁতের যাবতীয় সমস্যার আশ্চর্য নিরাময় সম্পর্কিত।
আজকে একটা ট্যাবলয়েডে হিলারির সাম্প্রতিক সফর দেশের জন্যে সুসংবাদ বয়ে নিয়ে আসবে বলে জানা গেছে।
এসব সুসংবাদ ববি মেনে নিতে পারে। কিন্তু কারো ব্যক্তিগত সুসংবাদে ভীষণ অনীহা তার। সে এসব ঘৃণা করে। কিন্তু প্রতিনিয়ত তাকে ব্যক্তিগত সুসংবাদ শোনানোর নিয়ত করেছে যেন পরিচিতজনেরা! প্রতিনিয়ত শুনতে হয়, এবং শ্রবণপরবর্তী মেকি উচ্ছাস যথাযথ হয়েছে কী না তা সম্পর্কে সচেতন হতে হয়। কী সুসংবাদ শোনাবে শুভ? বিয়ে করেছে? বিয়ে করে থাকলে একটা নাদুসনুদুস স্ফটিকস্বচ্ছ গ্ল্যাক্সো বাচ্চা হয়েছে? নাকি প্রমোশন? ইনক্রিমেন্ট? বিদেশ ভ্রমণ? এসব শুনতে শুনতে ক্লান্ত ববি।
বাসের বচসাটা আবার তাদের অবস্থানমুখী হলে পরস্পরের দৃষ্টিকেন্দ্রে একটা দেয়াল তৈরি হয়। এতে ববি তার সাময়িক ঈর্ষামিশ্রিত ক্ষোভ প্রশমনের সুযোগ পায়। মুখে একটি ফরমায়েশী হাসি ফোটাতে সক্ষম হয় অবশেষে। অপেক্ষা করে ভীড়টি সরে গেলে শুভর শুভ সংবাদটি শুনে তাকে অভিবাদনমূলক বাক্যাবলি বলার জন্যে। রড ধরে ঝুলে থাকা দুজন লোকের কোমড়ের ফাঁক দিয়ে চোখ গলিয়ে তার দিকে অত্যুৎসাহী ভাব ধরে প্রশ্নটি ছুড়ে দেয়।
-কী?
-আরে ববি নাকি! আছো কেমন?
বাসের ভেতর মানুষ বাড়ছে। ববি ঠিক নিশ্চিত হতে পারে না চেনাজানা মানুষদের সাথে দেখা হওয়াটা কেমন হবে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুৎ! একটু আগেই এখানে শুভ বসে ছিলো। তার জায়গায় রায়হান ভাই কখন এলো? শুভ কি নেমে গেছে? ভালোই হল। আজকের দিনটা ববির জন্যে শুভই বটে। তাকে কোন শুভ সংবাদ শুনতে হবে না। রায়হান ভাইয়ের কাছ থেকে অন্তত শুভসংবাদ পাবার কোন সম্ভাবনা নেই। তার সাম্প্রতিক খবর জানে ববি। বেচারা শেয়ার মার্কেটে বিশাল ধরা খেয়েছে। আগে ট্যাক্সি ক্যাবে করে চলত, এখন লোকাল বাসে চড়ে। রায়হান ভাইকে দেখে ববির আড়ষ্ট হয়ে আসা পেশীগুলো স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।
-আরে রায়হান ভাই যে! দিনকাল কেমুন যায়?
-ভালো না।
-কেন, কী হয়েছে?
তার বর্তমান দুরবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকার এবং তার কন্ঠে হতাশার সুরের পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা উদ্বিগ্নতা আরোপের অভিনয়টি করতে ববির মোটেই বেগ পেতে হয় না।
-আরে বইলো না! মেজাজটা খারাপ। নতুন কেনা গাড়িটা নিয়া বের হইসিলাম। মাঝপথে গেলো নষ্ট হয়া। এখন বাধ্য হয়ে এই লোকাল বাসের ভীড়ে ছ্যাবড়া হইতাছি।
যাহ শালা! এই লোক ভালো কামব্যাক করছে তো! গাড়িও বাগায়া ফেলসে! ববির মনটা তেতো হয়ে যায় ইঞ্জিনকাভারের আরামদায়ক আসনে বসে থাকা স্বত্ত্বেও। সে আর আলাপ চালিয়ে যেতে উৎসাহ পায় না। তবে এসবক্ষেত্র যা হয়, বক্তা অতি আয়েশের সাথে তার 'দুর্ভাগ্য' এবং "কঠিন জীবন" এর ফিরিস্তি দিতে থাকে দিস্তা দিস্তা জিহবা খরচ করে, বিলাস উপকরণের গেটিস সহকারে!
বাসের ভেতর মানুষ বেড়ে চলেছে। আরো বাড়ুক! আরো ভীড় হোক! বাকবিতন্ডা, হাতাহাতিতে হারিয়ে যাক চেনা, অর্ধচেনা, অচেনা সব মুখ! সব মুখ অচেনা হয়ে যাক!
রায়হান ভাই গভীর আগ্রহে চেয়ে আছে ববির দিকে, নতুন গাড়ি বিষয়ক অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নের উত্তর দিতে।
-কবে কিনলেন গাড়ি?
ববি এবার আর তার কন্ঠের নিস্পৃহ হতাশা লুকোতে পারে না। তার শোনার কোন ইচ্ছে নেই কে গাড়ি কিনছে, কে টাকা উড়োচ্ছে, কে প্রমোশন পাচ্ছে...
তবে আজ ববির ইচ্ছেপূরণের দিন। তার টেলিকাইনেটিক অথবা টেলিপ্যাথিক শক্তির প্রভাবে ( ববি এসব কস্মিনকালেও বিশ্বাস করে না, তবে আজকের ঘটনা পরম্পরার প্রেক্ষিতে এরকমটা ভাবতে মজা লাগছে তার) অথবা স্রেফ কাকতালীয়ভাবেই, অপ্রিয় কথোপকথনগুলো প্রলম্বিত হচ্ছে না। পরের স্টপেজ থেকে হুড়মুড় করে কিছু কলেজছাত্র উঠলে রায়হান ভাই আড়াল হয়ে যায়, তাদেরকে হাত দিয়ে সরিয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গীমায় প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করতে গেলে রায়হান ভাইয়ের জায়গায় সে নিপুকে আবিস্কার করে।
কখন কে এখানে আসে, যায়, বড় অদ্ভুত এই পরিবহন!
নিপুর সাথে অবশ্য ববির তেমন কোন পরিচয় নেই। অর্ধপরিচিত বলা যেতে পারে। একসময় শাহবাগে আড্ডা দেয়ার সুবাদে কিছু কবির সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিলো, তাদেরই বন্ধু নিপু।
নিপুর কোন সুসংবাদে ববি ঈর্ষাণ্বিত হবে না, আপেক্ষিক দুর্দশার কথা জেনে আনন্দিত হবে না।
-বাসটা যত এগুচ্ছে, মানুষ তত বাড়ছে। তাই না ববি?
নিপুই কথা শুরু করে।
-হ্যাঁ! বিরক্তিকর সব মানুষ!
-হয়তোবা আমার এখানে থাকার কথা ছিলো না।
-তুমি কিছুক্ষণ পরে থাকবেও না। তোমার জায়গায় অন্য কেউ এসে বসবে।
-কে এসে বসবে বলে তুমি আশা কর ববি? কোন গোলাপরঙা, সাগরচোখের মেয়ে? যার সাথে প্রথম দেখাতেই তোমার প্রেম হয়ে যাবে?
-না, তা ভাববো কেন?
-হু, তা অবশ্য ভাবার কথাও না। তোমার যা জীবন, তাতে এরকম ভাবার কোন অবকাশ নেই। অবশ্য আমি ভাবতে পারি! হাহাহা!
নিপুর বরফের ছুরির মত শীতল এবং নিষ্ঠুর কথা এবং হাসিতে বাসের মধ্যে নীরবতা নেমে আসে। থেমে যায় কন্ডাকটর এবং হেল্পারদের সাথে যাত্রীদের যাবতীয় বচসা। কর্কশ স্বরে ড্রাইভার ঘোষণা দেয় "গাড়ি আর যাইবো না, সবাই নামেন!"
নিপুও তাড়া দেয় সবাইকে। যাত্রীরা বিষণ্ন মনে নেমে যায়।
-দুঃখিত ববি, তোমার পলায়নপর সুখযাত্রাটি এখানে এভাবে পন্ড হল!
-কিন্তু আমি তো শুধু আজিমপুর থেকে মিরপুরে যেতে চেয়েছিলাম! ইজ দ্যাট আ বিগ ডিল?
-ঠিক আছে ববি, তাই হোক। তাই যাও। আমি উঠি কেমন? ড্রাইভার সাহেব, গাড়িটা ছাড়েন।
ফাঁকা বাসে আবার ঠেলাঠেলি করে যাত্রীরা উঠতে থাকে। ববি নিশ্চল বসে থাকে ফের গরম হয়ে ওঠা ইঞ্জিন কাভারের ওপর। তার সামনাসামনি আসনে শুভ এসে বসে ফের।
-ওহ! আপনারে তো সুসংবাদটা বলাই হইলো না!
রায়হান ভাই শুভর পাশেই জায়গা করে নেয়। কপট বিরক্তি তার চোখেমুখে।
-আর বইলো না! বউ এর ঘ্যানঘ্যানানিতে গাড়িটা কিনতেই হইলো।
নিপু এখনও যায় নি। সে খুব আলতোভাবে ববির কাঁধটা ছুঁয়ে কানে কানে বলে,
" তুমি চাইলে তোমার কানে ঘুঘুপাখির দুপুরবেলার ডাক রুমাল বানিয়ে বেঁধে দেব, তোমাকে ওসব কিচ্ছু শুনতে হবে না। তুমি চাইলে বাসে বাড়তে থাকা মানুষদের প্যাকেটভর্তি নক্ষত্রচূর্ণ দিয়ে মহাজাগতিক অনুভূতি এনে দিতে পারি, আমরা চাইলে বাসটাকে উল্কাগাড়ি বানিয়ে হারিয়ে যেতে পারি নীল নীল বায়বীয়তায়। তুমি চাও? আমি জানি তুমি চাও। আমিও চাই। খুব চাই। তবে আমি পারি, আর তুমি তা পারো না, এটাই পার্থক্য"
ববির শুনতে ভালো লাগে। তার সম্মোহিত চোখের দিকে তাকিয়ে নিপু বলে যায়,
"তবে এর থেকেও বড় সুসংবাদ তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে! বাস মিরপুরে এসে গেছে। শুভ নেমে গেছে শ্যামলীতে, রায়হান কল্যাণপুরে। আপাতত আর কোন সুসংবাদপ্রেরক নেই। আমিও না। নেমে যাও ববি। নামো"
-আই মির্পুর, মির্পুর, মির্পুর এ্যাক। নামেন।
একঘেয়ে কন্ঠস্বর কন্ডাক্টরের।
...........................................................................
বাস থেকে নেমে ববি নিপুকে দেখতে পায়। একটা চায়ের দোকানের সামনে বসে আছে।
-কি খবর নিপু? কবিতা লেখা ভালো চলছে?
-আরে ধুরো বাল! কবিতা চুদানোর টাইম আছে নাকি! কবিতা ফালায়া থুয়া সব লাটের বাট হইতাছে, বিজনেস ম্যাগনেট, কর্পোরেট মাফিয়া... আর আমি বাল...
নিপুর সাথে ববির কোনদিনও খুব একটু কথা হয় নি। তারপরেও ববি ভাবে তাকে এক কাপ স্পেশাল মালাই চা খাওয়ানো যেতেই পারে!

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মৃতবৎসা জোছনার কাল

তোমার জন্যে শুভ্র গোলাপ, বেড়ালতমা -হামিম কামাল