কণা এবং তার প্রিয় বন্ধু ডায়েরি
প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে ডায়েরিতে কিছু একটা লেখা কণার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। তার জীবনটা অবশ্য খুব দীর্ঘ না। সতেরো পেরুলো মাত্র। প্রথম যেবার তার জন্মদিন ঘটা করে পালিত হল, সেবার বাবার কাছ থেকে চমৎকার একটা ডায়েরি উপহার পেয়েছিলো সে। অনেকদিন ধরেই আবদার করে আসা উপহারটি পাওয়ার পর তার আনন্দ ছিলো দেখার মত! আনন্দের দিনগুলো অবশ্য কখনই দীর্ঘস্থায়ী হয়না। কণার বেলাতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। দশম জন্মদিনের কয়েকদিন পরেই জীবনের কাছ থেকে সে নিকৃষ্টতম উপহারটি পায়।
মৃত্যু!
সেদিন ডায়েরিতে সে বেশি কিছু লেখেনি। অবশ্য ঐ পরিস্থিতিতে লেখার মত মানসিক দৃঢ়তাই বা কজনের থাকে? কিন্তু ডায়েরিটা তার কাছে কেবল একটা উপহার অথবা কাগুজে শিল্পকর্ম ছিলোনা। সেটা হয়ে উঠেছিলো তার নিকটতম বন্ধু। বন্ধুকে তো সব বলাই যায়। তাই চোখের জল ফেলতে ফেলতে সে শুধু এটুকুই লিখেছিলো,
"বাবা, তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো, অনেক অনেক ভালো..."
"বাবা, তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো, অনেক অনেক ভালো..."
কণা অবশ্য কিছুদিন পর আরেকজন "বাবা" উপহার পায়। বোঝা হয়ে ওঠা সে আর তার মা'কে আত্মীয়স্বজনেরা আর টানতে রাজি হয়নি। তাদের একটা সুবন্দোবস্ত আর বাকি জীবনের নিরাপত্তার ছল অজুহাতে তার প্রায় অপ্রকৃতস্থ মাকে তুলে দেয় একজন টাকাওলা টেকো ব্যক্তির জিন্মায় বিবাহ নামক গ্রহণযোগ্য সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সময়ের সাথে সাথে অবশ্য তাদের এই সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত বলেই প্রতীয়মান হয়। অর্থ এবং জীবনের নিরাপত্তা পেয়ে আবার ঘুরতে শুরু করে সময়ের চাকা। জীবন চলতে থাকে নিদৃষ্ট গন্তব্যে। কিন্তু কণা ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হতে থাকে। নতুন বাসা, নতুন স্কুল, কাপড়চোপড়, জন্মদিনে নিয়ম করে গিফট কোনকিছুতেই কোন কমতি ছিলোনা। তার শুধু খারাপ লাগতো যখন সে দেখতো তার মায়ের উজ্জ্বল চঞ্চল চোখের তারায় শুধু শূন্যতা। সেখানে কোন বিষাদ বা আনন্দ নেই। মেয়ের দিকে আদর বা শাসনমাখা দৃষ্টি নেই। বাবার পরে মাকেও একরকম হারিয়েই ফেললো কণা। আর নতুন বাবা? তার সাথে সম্পর্কটা কখনই আনুষ্ঠানিকতার গন্ডি পেরুতে পারেনি। অবশ্য কণা তা চায়ওনি। তার আসল বাবাকে প্রতিস্থাপনযোগ্য ভাবেনি কোনদিনও।
বাসার গুমোট নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি পেতে কণা স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেশি করে মিশতে শুরু করে। তবে স্বভাবজাত খুঁতখুঁতানি এবং শূদ্ধতাবাদীতার কারণে সে খুব বেশিজনের ঘনিষ্ঠ হতে পারেনি। তার পরেও ঘরের চেয়ে স্কুল তার কাছে অনেক বেশি প্রিয় ছিলো। আনন্দের মুহূর্তগুলো সে লিখে রাখতো ডায়েরিতে। ডায়েরিটা! তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সব পাতা যেন শেষ না হয়ে যায় একারণে সে খুব অল্প অল্প করে লিখতো। দু-তিন লাইনের বেশি না কখনই। যেমন, সুন্দরবনে অসাধারণ সুন্দর তিনটা দিন কাটিয়ে আসার পর, যা তার কাছে ছিলো জীবনের শ্রেষ্ঠতম মুহুর্তগুলোর একটি, সে শুধু এতটুকু লিখেছিলো,
"ডিয়ার ডায়েরি, স্কুল থেকে প্রথমবারের মত পিকনিকে গেলাম। ওরা বলে শিক্ষাসফর, কিসের কি! অনেক মজা হয়েছে। এত ভালো লাগা কিভাবে প্রকাশ করতে হয় জানিনা আমি"
"ডিয়ার ডায়েরি, স্কুল থেকে প্রথমবারের মত পিকনিকে গেলাম। ওরা বলে শিক্ষাসফর, কিসের কি! অনেক মজা হয়েছে। এত ভালো লাগা কিভাবে প্রকাশ করতে হয় জানিনা আমি"
এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো কণার শান্ত, নিরুপদ্রব জীবন। একটা ব্যাপার নিয়ে অবশ্য সে মাঝেমধ্যে খুব চিন্তা করত, এই ডায়েরিটার পাতাতো একদিন না একদিন শেষ হবে। তখন সে লিখবে কিসে? কণার এই এক সমস্যা, সে যাদেরকে আঁকড়ে ধরতো তাদেরকে কখনই ছেড়ে যেতে পারতোনা। তাদের জায়গায় অন্য কাউকে ভাবতে পারতোনা। যেমনটা পারেনি বাবা-মা'র ক্ষেত্রে। তেমনটাই ঘটছে এই ডায়েরির ক্ষেত্রেও। তার এই "অপ্রতিস্থাপনবাদীতার" কারণে কম ভুগতে হয়নি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রিয় বন্ধুদের সাথে যখন মানসিক দূরত্ব বাড়তে থাকে, যখন স্বপ্না, সীমা অথবা রবিনদের সাথে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড,সেলফোন-মিসকল, ভাই বেরাদরদের 'লিটনের ফ্ল্যাটে'র সাথে সাহিত্য, গান, চিত্রকর্ম আর কিঞ্চিৎ শূচিবায়ূগ্রস্থতা এবং নীতিবাগিশতার ব্যাপরটা সাংঘর্ষিক হয়ে যায়, তখন কণাকে হারানোর কষ্টে ভুগতে হয়। নিজস্ব মতবাদগুলো তরুণী কণা খুব মেনে চলতো। এ ব্যাপারে সে ছিলো আপোষহীন।
হ্যাঁ! এখন তাকে তরুণী বলাই যায়। স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানের দিন কিছুটা স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরে সে লিখেছিলো,
"ডিয়ার ডায়েরি, বড় হয়ে যাচ্ছি! আর কিছুদিন পরেই কলেজে উঠবো হুহু। এখন থেকে আমার সাথে সম্মান করে কথা বলবা বুঝছো?"
লেখার পর কণা ফিক করে হেসে দেয়। ডায়েরির সাথে খুনসুটিতে মজা পেয়ে নাকি বড় হবার ব্যাপারটাকে তীর্যক ভঙ্গিতে দেখে ব্যঙ্গ করে, কে বলতে পারে! অবশ্য দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায়না। বয়সের তুলনায় ভারিক্বি মনের অধিকারী কণা এতদিনে জেনে গেছে বড় হওয়াটা সময়ের এক স্বৈরাচারী, নিষ্ঠুর হঠকারিতা। কম তো দেখেনি! বাড়তি হিসেবে মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের আবশ্যিক তীক্ষ্ণতা একটু বেশি পরিমাণে তো ছিলোই! যা একটু উন্মোচিত করলেই চারিদিকে বিকৃত রুচির অসংখ্য ভদ্রবেশী বদমাশ দেখতে পেতো। বাজে অভিজ্ঞতা কম হয়নি তার ওদের কাছ থেকে। রাস্তাঘাটে, বাসে, কোচিংয়ে...
"ডিয়ার ডায়েরি, বড় হয়ে যাচ্ছি! আর কিছুদিন পরেই কলেজে উঠবো হুহু। এখন থেকে আমার সাথে সম্মান করে কথা বলবা বুঝছো?"
লেখার পর কণা ফিক করে হেসে দেয়। ডায়েরির সাথে খুনসুটিতে মজা পেয়ে নাকি বড় হবার ব্যাপারটাকে তীর্যক ভঙ্গিতে দেখে ব্যঙ্গ করে, কে বলতে পারে! অবশ্য দ্বিতীয় সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায়না। বয়সের তুলনায় ভারিক্বি মনের অধিকারী কণা এতদিনে জেনে গেছে বড় হওয়াটা সময়ের এক স্বৈরাচারী, নিষ্ঠুর হঠকারিতা। কম তো দেখেনি! বাড়তি হিসেবে মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের আবশ্যিক তীক্ষ্ণতা একটু বেশি পরিমাণে তো ছিলোই! যা একটু উন্মোচিত করলেই চারিদিকে বিকৃত রুচির অসংখ্য ভদ্রবেশী বদমাশ দেখতে পেতো। বাজে অভিজ্ঞতা কম হয়নি তার ওদের কাছ থেকে। রাস্তাঘাটে, বাসে, কোচিংয়ে...
কণা কখনও এসব লেখেনি তার প্রিয় ডায়েরির পাতায়। অবশ্য তার প্রিয়তম এই বন্ধুটি এসব না লিখলেও জেনে যাবে, এটাও একটা কারণ। প্রথমবার বাজে অভিজ্ঞতা হবার পরে সে লিখতে গিয়েছিলো,
"জানো ডিয়ার ডায়েরি আজকে একটা বিশ্রী অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাসে উঠতে গিয়ে..."
"জানো ডিয়ার ডায়েরি আজকে একটা বিশ্রী অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাসে উঠতে গিয়ে..."
এইটুকু লেখার পরে তার মনে হয় যে ডায়েরিটা খুব মন খারাপ করেছে। ডায়েরির মন! অন্য কেউ শুনলে হাসবে হয়তো। কিন্তু কণা ঠিক ঠিক জানে তার ডায়েরিটার খুব সুন্দর একটা মন আছে যা, খুব খুব সংবেদনশীল এবং কণাকে বুঝতে পটু। তাই খামোখা বাজে অভিজ্ঞতাগুলো লিখে ডায়েরির আনন্দ-বেদনায় ভরা বর্ণিল পাতাগুলোতে ছোপ ছোপ কালি লেপতে দিতে চায়নি।
আজকে কণার প্রথম কলেজে যাবার দিন। যাবার সময় "বাবা" আর মাকে বলে যাওয়ার ভদ্রতা করতে ভুললোনা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, সম্পর্কগুলো এখন ভদ্রতা আর আনুষ্ঠানিকতার সুতো দিয়ে বাধা। মাকে বলা আর না বলা অবশ্য একই কথা। এখন সে জগতের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন এবং নির্লিপ্ত, প্রায় জড়বস্তুস্বরূপ।
তারপরেও সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
"আজ আমার কলেজের প্রথম দিন, যাচ্ছি মা, দোয়া কর"
প্রতিক্রিয়া বলতে মা বিড়বিড় করে কিসব যেন বলতে লাগলো, তা আশীর্বাদ বা অভিসম্পাত যে কোন কিছুই হতে পারে। কোনোটাই অসম্ভব না!
"বাবা"র সাথে যথারীতি ফর্মালি এবং ভাববাচ্যে কথা হল।
"যাচ্ছি, আজকে থেকে কলেজ শুরু"
"ওহ তাই নাকি? বেস্ট অফ লাক কণা। ভালোভাবে পড়াশোনা কর" বলেই আবার খবরের কাগজ পড়ায় মন দিলো সে। এরকমই তাদের সম্পর্ক। বাসায় পারতপক্ষে কণা কখনও তাকে বাবা বলে ডাকেনা। বাইরে অবশ্য মানুষের সামনে ডাকতেই হয়। আর ডায়েরিতে তাকে সম্বোধন করা হয় ইনভার্টেড কমার ভেতর রেখে।
তারপরেও সে মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
"আজ আমার কলেজের প্রথম দিন, যাচ্ছি মা, দোয়া কর"
প্রতিক্রিয়া বলতে মা বিড়বিড় করে কিসব যেন বলতে লাগলো, তা আশীর্বাদ বা অভিসম্পাত যে কোন কিছুই হতে পারে। কোনোটাই অসম্ভব না!
"বাবা"র সাথে যথারীতি ফর্মালি এবং ভাববাচ্যে কথা হল।
"যাচ্ছি, আজকে থেকে কলেজ শুরু"
"ওহ তাই নাকি? বেস্ট অফ লাক কণা। ভালোভাবে পড়াশোনা কর" বলেই আবার খবরের কাগজ পড়ায় মন দিলো সে। এরকমই তাদের সম্পর্ক। বাসায় পারতপক্ষে কণা কখনও তাকে বাবা বলে ডাকেনা। বাইরে অবশ্য মানুষের সামনে ডাকতেই হয়। আর ডায়েরিতে তাকে সম্বোধন করা হয় ইনভার্টেড কমার ভেতর রেখে।
"বাবা"
যেমন, "বাবা" আজকে বলল...
কলেজের দিনগুলো ভালোই কাটছিলো কণার। স্কুলের প্রিয় বন্ধুদের সাথে বন্ধুত্বপবর্তী দূরত্বের কথা মনে রেখে কণা এখন আর কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী হয়না। পড়ালেখার মধ্যে ডুবে থাকে। হঠাৎ একদিন কি যে হল!
কণার সতর্কতার সাথে তৈরী করা দূরত্বের সেতূটা ভেঙে গেলো হৃদয়ের প্রবল রক্তোচ্ছাসে!
সেদিন কণা ডায়েরিতে দুকলম বেশিই লিখেছিলো।
"এসব কি হচ্ছে বলত ডিয়ার ডায়েরি? এতদিন ধরে কত সুন্দর দেখতে, বুদ্ধিমান, বখাটে, অথবা লাফাঙ্গা টাইপ যাবতীয় ছেলের আকূল প্রেম প্রস্তাব অথবা ফাঁদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি অবজ্ঞার অব্যর্থ অস্ত্র প্রয়োগ করে, কিন্তু আজ..."
ডায়েরিটা বুঝতে পেরে দুষ্টুমি করে কণাকে চোখ টিপি দেয়।
"দুষ্টু ডায়েরি!" বলে কণা অযথাই হাসিতে ভেঙে পড়ে।
ডায়েরিটা বুঝতে পেরে দুষ্টুমি করে কণাকে চোখ টিপি দেয়।
"দুষ্টু ডায়েরি!" বলে কণা অযথাই হাসিতে ভেঙে পড়ে।
এখন কণার ডায়েরির পাতাগুলো খুব দ্রুত ভরে যাচ্ছে। বিষয়বস্তুও সেই একই।
"আজকে ওর সাথে সিনেমা দেখে এলাম..."
"আজকে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বসে অনেক্ষণ গল্প করেছি"
"আজকে না ওকে খুব সুন্দর লাগছিলো! নীল রঙটা ওকে খুব সুন্দর মানায়। আমিই অবশ্য কিনে দিয়েছি..."
ডায়েরির পাতা দ্রুত ভরে যাচ্ছে। কণা আগে এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করত। কিন্তু এখন সে মোটেও চিন্তিত না। ডায়েরি লেখাটা অভ্যেস হয়ে গেছে, এখন "এটা" (ডিয়ার ডায়েরি না বলে "এটা" বলায় ডায়েরিটা কতটা মন খারাপ করেছিলো তা যদি কণা জানতো!) শেষ হয়ে গেলে আরেকটা কেনা যাবে। আপাতত তার সমস্ত চিন্তা ভাবনা আবর্তিত হচ্ছে "ও"কে ঘিরে। কণার এই এক সমস্যা, যাকে আঁকড়ে ধরে, তাকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারেনা।
"আজকে ওর সাথে সিনেমা দেখে এলাম..."
"আজকে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে বসে অনেক্ষণ গল্প করেছি"
"আজকে না ওকে খুব সুন্দর লাগছিলো! নীল রঙটা ওকে খুব সুন্দর মানায়। আমিই অবশ্য কিনে দিয়েছি..."
ডায়েরির পাতা দ্রুত ভরে যাচ্ছে। কণা আগে এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করত। কিন্তু এখন সে মোটেও চিন্তিত না। ডায়েরি লেখাটা অভ্যেস হয়ে গেছে, এখন "এটা" (ডিয়ার ডায়েরি না বলে "এটা" বলায় ডায়েরিটা কতটা মন খারাপ করেছিলো তা যদি কণা জানতো!) শেষ হয়ে গেলে আরেকটা কেনা যাবে। আপাতত তার সমস্ত চিন্তা ভাবনা আবর্তিত হচ্ছে "ও"কে ঘিরে। কণার এই এক সমস্যা, যাকে আঁকড়ে ধরে, তাকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারেনা।
তারপর একদিন...
কণা সব দেখলো, জানলো, বুঝলো। খেলার নিয়মকানুন সম্পর্কে অবহিত হল।
নাহ, কণা কোনরকম ঝগড়া করেনি, কৈফিয়ত চায়নি, প্রতিশোধপরায়ণ হয়নি। ওসব তার ধাতেই নেই। সে নিঃশব্দে চলে এসেছিলো। আগেকার দিন হলে কণা হয়তো অনেক কাঁদতো। কিন্তু এখন দুঃখ পেলে তার অশ্রুগুলো পাথর হয়ে বুকে জমে থাকে। সে কাঁদতে পারেনা।
নাহ, কণা কোনরকম ঝগড়া করেনি, কৈফিয়ত চায়নি, প্রতিশোধপরায়ণ হয়নি। ওসব তার ধাতেই নেই। সে নিঃশব্দে চলে এসেছিলো। আগেকার দিন হলে কণা হয়তো অনেক কাঁদতো। কিন্তু এখন দুঃখ পেলে তার অশ্রুগুলো পাথর হয়ে বুকে জমে থাকে। সে কাঁদতে পারেনা।
ঐদিন রাতে, ঠিক ঐদিনই গভীর রাতে তার গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে থাকা "বাবা" তার অপ্রকৃতস্থ মায়ের সাথে শীতল কন্ঠে যাচ্ছেতাই সব বলতে লাগলো।
বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে গভীর রাতে কণা নানারকম বিচিত্র, রহস্যময় শব্দাবলি, এবং পাশবিক শিহরণ ধ্বণি শুনে এসেছে এতকাল অনিচ্ছা স্বত্তেও। কান চেপে ধরে রাখতো সে। কিন্তু কান্না চাপতে পারতোনা।
আজকে রাতেও! কেন বেছে বেছে আজকে রাতেই! একজন অপমানিতা বিগতযৌবনা নারী আর একজন কামাতুর লোভী পুরুষ...
"তোমার চেয়ে একটা কোলবালিশের পারফরমেন্স হাজারগুণ ভালো হবে। হারামজাদি, এরকম কাঠ হয়ে থাকিস কেন?"
"ডিয়ার ডায়েরি..."
লিখতে শুরু করে কণা। কিন্তু কি লিখবে!
দরজায় ধুপধাপ শব্দ
আর তার বুকে ধুকধুক
আর তার বুকে ধুকধুক
"কণা, মা! কি কর এত রাত্তিরে বাতি জ্বালিয়ে? আসো আজকে আমি তোমার সাথে অনে...ক গল্প করব"
কণার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় জেগে ওঠে। ডায়েরিটা ওকে সাবধান করে দেয়। ডায়েরিটাতো আসলে শুধুমাত্র অফসেট পেপার আর হার্ড বাইন্ডিংয়ের সুন্দর মলাটের কোন নিস্প্রাণ বস্তু না। কণা তাকে এতদিন পেলেপুষে বড় করেছে। তাকে প্রাণ দিয়েছে। অজস্র প্রাণ, অজস্র স্মৃতি...
চরিত্রেরা বের হয়ে আসে ডায়েরির ভেতর থেকে।
অনেকদিন পর ওর বাবা আসে।
"কণা, মা ভয় পেওনাতো! আমি তোমার সাথে আছিনা?"
"এই কণা দরজা খুলছোনা কেন?"
ওপাশ থেকে গর্জ ওঠে লোকটা।
কণা দশ বছর বয়েসি সেই মেয়েটার মত বাবার কোলে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। তার বুকে মুখ গুঁজে দেয় নির্ভরতার পরমতম অবলম্বন মনে করে।
"কণা, মা ভয় পেওনাতো! আমি তোমার সাথে আছিনা?"
"এই কণা দরজা খুলছোনা কেন?"
ওপাশ থেকে গর্জ ওঠে লোকটা।
কণা দশ বছর বয়েসি সেই মেয়েটার মত বাবার কোলে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। তার বুকে মুখ গুঁজে দেয় নির্ভরতার পরমতম অবলম্বন মনে করে।
"ওই কণা, দরজা খোল! এতদিন ধরে তোর পেছনে অনেক টাকা খরচ কর্ছি। গায়ে গতরে মাশাল্লাহ হইছো। আইজকা সব উশুল করুম"
দরজার ওপাশ থেকে একটা পশুর উন্মত্ততা বেড়েই চলে।
কণার বন্ধুরা ডায়েরির পাতা থেকে বের হয়ে আসে এবার। স্বপ্না, সীমা, রবিনরা। এতদিনকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে বিপদের সময় বন্ধুত্বের পতাকা কপালে বেঁধে ওরা এসেছে।
"আরে দোস্ত চিন্তা করিসনা, ঐ হারামজাদাটাকে দেখ না আজকে কি করি!"
"আরে দোস্ত চিন্তা করিসনা, ঐ হারামজাদাটাকে দেখ না আজকে কি করি!"
এতসব শুভানুধ্যায়ী পেয়ে কণা ভরসা পায়। আজকে এই কামোন্মত্ত পার্ভার্ট শুকরটাকে আর আস্ত রাখা হবেনা। সবাই এসে গেছে।
"খানকি মাগী, তুই ভাবছিস তুই কি করিস আমি জানিনা? দুনিয়াশুদ্ধা পোলাপাইনের লগে পীরিত কইরা বেড়াও, শরীরের সুখ দাও, আর আমি চাইলেই তোর কৌমার্য চেতনা উপচায়া পড়ে! খোল দরজা!"
ডায়েরির ভেতর থেকে তার প্রাক্তন প্রেমিক বের হয়ে আসে এবার। শয়তানি হাসি হেসে বলে,
"আমি চাইছিলাম, পাইনাই। আজকে তুমি বাটে পর্ছ ডার্লিং! দরজা না খুইলা যাইবা কই?"
"আমি চাইছিলাম, পাইনাই। আজকে তুমি বাটে পর্ছ ডার্লিং! দরজা না খুইলা যাইবা কই?"
তাকে অবশ্য ছুরির এক পোঁচেই শেষ করে দেয় ইদানীং রাজনৈতিক আশ্রয়ে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা রবিন, যার সাথে নীতিগত বিরোধের কারণে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কণার।
কণা ভয় পেয়ে ডায়েরিটা বন্ধ করে রাখে। নাহলে আরো কে কে বের হয় কে জানে!
দরজায় করাঘাতে শব্দ ক্রমশঃ বেড়ে চলে। ভেঙেই ফেলে কিনা! কণা আতঙ্কিত হয়। তবে তাকে রক্ষার জন্যে বাবা, মা আর বন্ধুরা তো আছেই! তারা বিভিন্ন যান্ত্রিক সরঞ্জাম দিয়ে দরজাটা সিলগালা করে দেয়। এপাশ থেকে। ওপাশের ক্রুদ্ধ, কামার্ত চিৎকার অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে যায়।
"এখানে আর থাকিসনে কণা, চল যাব তোকে নিয়ে..."
সস্নেহে মা বলেন। এতদিন পর মায়ের আদর পেয়ে কণা অনেকদিন পর খুব কাঁদে।
তার বন্ধুরা ততক্ষণে এই বিভীষিকাময় ঘর থেকে বের হবার জন্যে যন্ত্রপাতি নিয়ে একটি সুরঙ্গ খুড়তে ব্যস্ত।
"তোর বন্ধুরা বেশ কাজের রে! এই তো শেষ করে ফেলেছে প্রায়" বাবা বলেন পরিতৃপ্তির সাথে।
খননকার্য শেষ করে ওরা সবাই সুরঙ্গ দিয়ে বের হবার প্রস্তুতি নেয়।
সুরঙ্গের ওপাশ থেকে অপার্থিব আলো কণার মুখে এসে পড়ে। মায়ামায় ওই পথ ধরে তারা চলতে থাকে এক কল্পনগরীর দিকে। সবার সাথে হাসিতে, আনন্দে চমৎকার ভ্রমণ উপভোগ করতে থাকে কণা। সাথে অবশ্য ডায়েরিটা নিতে ভোলেনি সে। তার প্রিয় বন্ধুটা! তাকে ভোলে কি করে? কিন্তু হঠাৎ এক অসতর্ক মুহূর্তে কনার হাত থেকে ডায়েরিটা পড়ে যায়। নিমিষেই মায়াময় সুরঙ্গ, বাবা-মার স্নেহময় মুখ, প্রাণোচ্ছল বন্ধুরা, অপার্থিব আলো, সব উধাও হয়ে যায়!
কণা আবার নিজেকে আবিস্কার করে নিজের ঘরে। একা!
এখন অবশ্য আর ওপাশ থেকে উন্মত্ত লোকটার পাশবিক গর্জন শোনা যাচ্ছেনা। ক্লান্ত হয়ে ফিরে গেছে বোধ হয়।
"এর পরে আবার সেই লোকটা আসবে ডিয়ার ডায়েরি, তখন তুমি আমাকে এভাবে রক্ষা করবেতো?"
ডায়েরিটাকে শুধোয় কণা।
কিন্তু কোন জবাব আসেনা।
ডায়েরিটাকে শুধোয় কণা।
কিন্তু কোন জবাব আসেনা।
ডায়েরিটাও হয়তোবা ক্লান্ত, ভাবে কণা। আজ তো ওর ওপর দিয়ে কম ধকল গেলোনা! তবে একদিন আবার সবাই আসবে, মৃত্যুনগরী থেকে বাবা, অপ্রকৃতস্থতা কাটিয়ে মা, ব্যবধান ঘুচিয়ে বন্ধুরা.....তাকে নিয়ে যাবে সেই মায়াময় সুরঙ্গপথের ওপাড়ে।
এই আশা বুকে পুষে, চোখের পাতায় স্বপ্নের কাজল মাখিয়ে ঘুমুতে যায় কণা...
Comments
Post a Comment