অফ স্পিন



নেহালের বয়স এখন বার। উন্মুক্ত কল্পনারাজ্যে বল্গাহীনভাবে অনিঃশেষ ছোটাছুটি করার সময়। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসন অথবা ঠাকুরমার ঝুলির চরিত্রগুলোর সাথে নিবিড়তা বজায়ের পাশাপাশি রহস্য অনুসন্ধানী গোয়েন্দার আতশ কাচে পৃথিবীটা অন্য চোখে পরখ করার সময়। স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে পেপারব্যাক থ্রিলারগুলো কিনে বন্ধুদের কাছে চোখ বড় করে কাহিনীর চমকগুলো বলতে গিয়ে ঝালমুড়ি বিকেল শেষ হয়ে যায় নিমিষেই। ক্লাস সিক্সের ক্রিকেট দলের 'দুধ ভাত' অথবা সংবাদ প্রতিবেদকের ভাষায় 'দ্বাদশ ব্যক্তি' নেহাল গায়ে গতরে তেমন বেড়ে না ওঠায় পেস বোলিং করার চেষ্টা বাদ দিয়ে অফ স্পিন শিখছে। ক্লাস ক্যাপ্টেন নিশাত এবং ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন নির্ঝর দুজনেই বেশ জোরে বল করতে পারে। এইতো সেদিন দুই ক্লাস ওপরের ছেলেদেরকে দুই লিটার কোক বাজির ম্যাচে হারিয়ে দিল এই দুজনের দুর্দান্ত গতিময় বোলিং এর তোড়েই। ওইদিনের ম্যাচে কিছু সময়ের জন্য ফিল্ডিং করেছিল নেহাল। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত দুটো চার বাঁচিয়ে দিয়ে সবার বাহবা পেয়েছিল। এমনতর বাহবা পেলে কার না ইচ্ছে করে নিয়মিত তার ভোক্তা হতে! নেহাল তাই ক্লাস টিমে ঢোকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মুরালিধরনের বোলিং এর কিছু ভিডিও দেখেছে সে ক'দিন খুব মনযোগ দিয়ে, কিন্তু পরে মুরালি হবার চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়েছে অদ্ভুত বোলিং এ্যাকশন অনুকরণ করতে পেরে উঠছিল না বলে। এরচেয়ে গ্রায়াম সোয়ানকে ট্রাই করা যেতে পারে। কব্জির কারুকাজ ধীরে ধীরে রপ্ত করছে সে। বলের লাইন লেংথ এলোমেলো হয়ে গেলেও মাঝে মধ্যে অফসাইডের বাইরের বল সাঁই করে স্পিন করে মিডল স্ট্যাম্পের দিকে ঢুকে জবরদস্ত কোন ব্যটসম্যানকে ভড়কে দিলে নেহাল স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষের হর্ষধ্বনি আর হাততালি শুনতে পায়। রাতে ঘুমানোর আগে মুদ্রিত হরফের তৈরি রূপকথা এবং রহস্যের রাজ্যে পরিভ্রমণ করার সময় স্পিন বোলিং এর চতুর দক্ষতার কথা ভেবে গর্ব হয় তার। তবে নতুন পাওয়া বইগুলো- কিছু কেনা, কিছু উপহার পাওয়া, কিছু ধার করা, পড়ার সময় টিনটিনের এ্যাডভেঞ্চার, ফেলুদার রহস্যানুসন্ধান আর রূপকথারঙ রাতের সাথে আঁতাত করে সুখনিদ্রায় নিমজ্জিত হলে পরে খেলার মাঠটায় বরফ কুঁচি ছিটিয়ে দেয় এস্কিমোরা। বরফমাঠে খেলা থেমে থাকে না। বার বছর বয়সের মনমাঠে রূপকথা এবং রহস্যদলের খেলোয়াড়দের অভাব হয় না কখনো। আর...
নতুন নতুন রূপকথাতো সৃষ্টি হচ্ছেই দিনকে দিন!

রূপকথা

রূপকথার বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর চীনেরগুলো। রূপকথার নবতর পাঠ উন্মোচিত হচ্ছে নেহালের কাছে। বয়ঃসন্ধিজনিত পরিবর্তন আর শিহরণ, যেগুলোকে একসময় শারিরীক অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতা মনে করে ভয় পেতো নেহাল, এখন সে জানে 'বড়'দের এসব জিনিস 'ছোট'রা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে পারে। সে যা জানে না তা হল বড়দের চর্চিত অভ্যাসগুলো যখন নতুন জানা হয় শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে সৃষ্ট পুলকের ঢেউ কতটা বিপজ্জনকভাবে অভ্যস্ত কামচেতনার একঘেয়ে আনন্দকে তাড়া করতে পারে, এমনকি হটিয়েও দিতে পারে। নতুন রূপকথার চরিত্রগুলোর মধ্যে চৈনিকেরা নেহালের প্রিয়তর। এখন সে জীবন্ত রূপকথা দেখতে শিখেছে। সে এক অন্য জগৎ, অন্য শিহরণ। শুধু দেখতেই ইচ্ছা করে। চাপা নাক আর ছোট চোখ, সিল্কি চুল,...চিৎকার চিৎকার!!

প্রথমে তাকে শিখিয়েছিল ক্লাস ক্যাপ্টেন নিশাত। শুরুর দিকে দুজন মিলেই গোপন এই পরিভ্রমণে অংশ নিতো। পরের দিকে ক্রিকেট ক্যাপ্টেন নির্ঝর যুক্ত হওয়াতে সম্মিলিত প্রয়াসে রূপকথার সংগ্রহশালা সমৃদ্ধ হতে থাকে। চাপা নাক, ছোট চোখ, হলুদ ত্বকের সাথে যুক্ত হয় শ্বেত অঙ্গ, চকলেট শরীর, নীল চোখ, গোলাপী ঠোঁট, শুভ্র বুক, কড়া গন্ধযুক্ত দক্ষিণ আমেরিকান ফুলের খয়েরী বৃন্ত।

নতুন রূপকথা, নতুন চরিত্রগুলোতে বুঁদ হয়ে থাকলেও পুরনো বইগুলোকে এখনো ভীষণ ভালবাসে নেহাল। যেমন, পিনোকিও। ভয় হয়, ইদানিং প্রচুর মিথ্যে কথা বলতে হচ্ছে তাকে, পিনোকিওর মত তার নাকটা আবার বড় হয়ে যাবে না তো! পিনোকিও, বেচারা রূপকথা বইয়ের কাঠবালক কী বিপদেই না পড়েছিল। রূপকথা, বোগাস। তবে তারপরেও ভাল লাগে। নতুন রূপকথাগুলো পুরো পৃথিবীর সমস্ত দেশ-মহাদেশ অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে প্রবল পরাক্রমে। রাশিয়ান, লাতিনো, ইতালিয়ান, তবে আপাতত তারা দেশী রূপকথাতেই নিমগ্ন থাকতে চাইছে। ঠাকুরমার ঝুলি হাতড়িয়ে দৈত্য-দানব, পরী বের করে তারা। পরীদের বিশেষ পরিচর্যা করে। জসীমউদ্দীনের বাঙ্গালীর হাসির গল্পের ষোলকলা জানা বুদ্ধিমতী গ্রামীণ বউ এর কাহিনী পড়ে খুব হেসেছিল সেদিন। এখন চাইছে ষোলকলার মধ্যে আট কলা দেখানো বউটির অপ্রদর্শিত কলা-কৌশল দেখতে। চাইলেই তো দেখা যায়। শুধু একটু সাহস থাকলেই হয়। নীলক্ষেতের মোড়ে একদিন সাহস করে চলে যাবে নাকি? স্কুলব্যাগ দেখে যদি আবার কড়কে দেয়! সাহসের থলেতে খুচরো পয়সা জমে, কিন্তু তা বড় নোট হয়ে উঠতে পারে না। তাই আপাতত লম্বা নাক নিয়ে কাঠবালকেরা ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকে বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে। বাসায় ফিরতে মাঝেমধ্যে দেরী হয়ে যায়। তাদের নাকও বাড়তে থাকে। পিনোকিও যে এখনও বসবাস করে বালকদের মাঝে!

রহস্য

সাম্প্রতিককালে পঠিত রহস্যোপোন্যাসের মধ্যে নেহালের পছন্দ হয়েছে ফেলুদার "রয়েল বেঙ্গল টাইগার রহস্য"। নিশাতের অবশ্য ফেলুদা তেমন পছন্দ না। সে তিন গোয়েন্দার ভক্ত। আর নির্ঝর শার্লক হোমস বলতে অজ্ঞান। তাদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ তর্ক হয়।
-ফেলুদার মত আর কেউ নাই
-কিশোর পাশা বস!
-আরে ধুর শার্লক হোমস হইল সবার গুরু। ফেলুদা চরিত্রটাতো বানাইসেই তারে দেইখা।
-যত যাই বল, শার্লক হোমসের "রয়েল বেঙ্গল রহস্য"র মত বই নাই একটাও।
-এহ বাস্কারভিলের হাউন্ড পড়ছিস?
-কাকাতুয়া রহস্য বেস্ট!
-ছিন্নমস্তার অভিশাপ!
-রক্তচক্ষু
-আ স্টাডি ইন স্কারলেট

গোয়েন্দা বইয়ের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকলেও পাঠক হিসেবে নতুন হবার কারণে নিজেদের পছন্দের নায়কের শ্রেষ্ঠত্তের দাবী তোলা নামাশ্রয়ী তর্ক বেশিক্ষণ চলতে পারে না। তবে তাদের বয়সে কথার মাঝে হঠাৎ নীরবতা নেমে এলে তা ছায়া ফেলতে পারে না বেশিক্ষণ। বালকেরা আলোক খোঁজে। বালকের দল ঈপ্সিত লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবমান হয়। রহস্য অবগুন্ঠনে বালকদের মত একনিষ্ঠ কৌতুহলী কর্মী আছে আর কারা? তারা নিজেদের গোয়েন্দা দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। পাশের বাড়ির আলোটা কেন জ্বলেছিলো সারারাত? স্কুলের পাশের পুকুরটায় কারা নাকি রাত তিনটেয় এসে বিষ মাখিয়ে সমস্ত মাছ মেরে ফেলবে? অংক স্যারের চাচাতো ভাই কেন বের হয়না বাসা থেকে জানিস? চারটে খুনের আসামী, হু! সবই বিশ্বস্ত সুত্র থেকে পাওয়া খবর।

আলোকবালকদের চোখ ফাঁকি দেবে কে? তারা টর্চ দিয়ে সমস্ত এলাকা, ক্লাশরুম, প্রতিবেশী, সবাইকে, সবকিছুকে চষে ফেলছে।
অভিশপ্ত পুকুর। রহস্যময় বাড়ি। অংক স্যারের আশ্রিত ছোট ভাই ফেরারী। পাশের বাসার তরুণী মেয়েটা দুঃখী। সে হাসে না কেন? নজর রাখতে হবে। সে কি নির্যাতিতা? জানতে হবে। তার মন খারাপ কেন? সে লাল রঙ বেশি পছন্দ করে?
-আজকে তার ব্রায়ের স্ট্র্যাপ দেখসি!
-কিপ ওয়াচিং ওয়াটসন! ভালো ক্লু। দেখতে থাক। আরো অনেক কিছু জানবি।
তারা একসাথে হলে ইদানিং এই রহস্যময়ী বালিকাকে কেন্দ্র করেই উদঘাটিতব্য রোমাঞ্চের কার্যক্রম নির্ধারণ করে।
-আমাদের চেয়ে তিন বছর বড়। ষোল।
-গুড ইনফরমেশন রবিন!
-তাদের বাসায় নতুন গোসলখানা করেছে। ভেন্টিলেটর দিয়ে সব দেখা যায়।
-তুই গোসল দেখিস?!
-হ্যাঁ! জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে।
-ধরা পড়লে?
-আরে লাইট নিভায়ে ঘর অন্ধকার করে রাখি।
-রহস্য আরো জমে উঠেছে। আমাদের সাহায্য তোমার প্রয়োজন হবে। তোদের বাসা ফাঁকা থাকবে কবে?
-আমি জানাবো।
-কী কী দেখা যায় ক তো! কী কী দেখলি?

বালকের দল ঘন্টার পর ঘন্টা এ নিয়ে আলাপ চালিয়ে যায়। তাদের শোনার তৃষ্ণা শেষ হয়না। প্রতিবার যুক্ত হয় নতুন প্রশ্ন। বক্তা বালক বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে নতুনভাবে বর্ণনা করতে থাকে। আলাদা আলাদা বর্ণনার গড়মিল খুঁজে পেলেও শ্রোতাবালকের দল তাদের গোয়েন্দা মনোবৃত্তি চেপে রাখে, সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের দক্ষতা দিয়ে আরোপিত অংশগুলো ধরিয়ে দিয়ে কৃতিত্ব নেবার বদলে সাগ্রহে শুনে যায়, নিজেরাও যোগ করে এবং সেসব বক্তাবালকের সাগ্রহ অনুমোদনে সানন্দে সংযোজিত হয়। শুনতে শুনতে তাদের কান বিদ্রোহ করে চোখ অভিমুখী হয়ে নতুন দাবী জানায়। তাদের চোখ পুড়তে থাকে পলিথিনের ব্যাগে একটা জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি নিক্ষেপ করলে যেমন কুচকেমুচকে নিমিষেই পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় তেমনভাবে। চোখ পোড়ে, চোখ জ্বলে, চোখ যন্ত্রণাকাতর হয়। তারা আর সইতে পারে না।
-কবে তোদের বাসা ফাঁকা থাকবে বল না বাইনচোৎ!
-আরে গালি দ্যাস কেন! হলে তো আমি জানাবোই।
-কবে জানাবি!
তাদের মধ্যে একটা হই-চইয়ের উপক্রম হলে সচেতন অভিভাবিকা মাতৃসুলভ উদ্বিগ্নতা এবং যত্ন ইচ্ছা নিয়ে সন্তান এবং তার বন্ধুদের কাছে আসেন,
-এই নেহাল কী হয়েছে? এত গোলমাল করছিস কেন? বাবারা, তোমরা কিন্তু খেয়ে যাবা। গরুর মাংসের ভুনা করেছি লেবু আর লেটুসপাতা দিয়ে।
-না আন্টি, অনেক দেরী হয়ে গেছে। আমাদের যেতে হবে। আপনারা নাকি পিকনিক করতে যাবেন গাজীপুরের দিকে, কবে?
-হ্যাঁ, এইতো এই সপ্তাহেই যাবো সবাই মিলে। নেহাল খুব করে ধরেছে।
-যান আন্টি। খুব ভালো জায়গা। নেহাল, তুই আমাদের জানাবি কিন্তু ঠিক আছে? আচ্ছা আন্টি, এখন যাই।

বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় তারা নেহালের আচরণে সন্দেহ করার উপকরণ খুঁজে পায়। সে কি আসলেই তাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে গাজীপুরে চলে যাবে? ফাঁকা বাসায় অভিযান হবেনা! রহস্য উদঘাটিত হবে না?

এ্যাডভেঞ্চার

-নেহালটা ইদানিং কেমন এড়িয়ে চলছে আমাদের খেয়াল করেছিস নির্ঝর?
-হু, ভয় পাইছে।
-ভয় পাবে কেন! আমরা কী ওর কোন ক্ষতি করতে যাচ্ছি নাকি?
-গাজীপুরে পিকনিকে না যায়া একা বাসায় থাকবে কী বইলা এটা নিয়া চিন্তিত।
-আরে এইটা কোন ব্যাপার নাকি, ধুর! বলবে যে শরীর খারাপ। তোমরা যাও।
-কিন্তু তাইলে যদি তার ফ্যামিলির লোকেরা না যায়?
-তাও তো কথা। আচ্ছা নেহালের কাছে কি বাসার চাবি আছে? দিয়ে যাবে আমাদের?
-জিগাইসিলাম। নাহ। চাবি নাই অর কাছে।
-তাহলে চাবি বানায় নিতে হবে।
-তাইলে চাবি চুরি করতে হবে আগে।
-তা সে সামান্য এই কাজটা পারবে না! গোয়েন্দা বই পড়ে আন্ডা শিখছে সে!

নেহালের আগমনে তাদের কথাবার্তায় ছেদ পড়ে। ছুটির পর তাদের ম্যাচ প্র্যাকটিস করার কথা থাকলেও কর্দমাক্ত মাঠের কারণে ঝিমিয়ে আড্ডা দিয়েই বিকেলটা কাটাচ্ছিলো তারা। নেহালের চোখেমুখে দারুণ উৎসাহ, যেন দারুণ কোন একটা সারপ্রাইজ নিয়ে এসেছে।
-কী রে এরকম লাফাতে লাফাতে কোত্থেকে আসলি? ক্লাশে তো একটা কথাও বললি না আজকে। শোন, তোর সাথে জরুরী কথা আছে।
-আরে রাখ তোদের কথা! এই দেখ, "যকের ধন"-হেমেন্দ্রকুমার রায় এর। বাংলা ভাষার অন্যতম বেস্ট এ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস। ইশ, কত যে খুঁজতে হল এটাকে!
-যকের ধন! আরে এটা আমি পড়া শুরু করেছিলাম। বিমল, কুমার কী ক্যারেক্টার আর সাসপেন্স! পুরাটা পড়তে পারিনাই। হারায় গেছিলো। আসলেই দারুণ এ্যাডভেঞ্চার। কবে দিবি এটা বল!
-আমার পড়া শেষ হোক। কালকে তো ছুটি। ওহ, কালকেই তো আমাদের পিকনিকে যাবার কথা। নাহ কালকে দিতে পারবো না রে। শনিবার নিস।
-শনিবার! কীসের শনিবার? আর তোর তো পিকনিকে যাবার কথা না। তুই কালকে বাসায় থাকবি।
-হু, মনে আছে আমার। দেখি ম্যানেজ করা যায় কী না।
-ম্যানেজ না করার কী হইল? ম্যানেজ করবি যেভাবে হোক!
-আরে বোঝার চেষ্টা কর! আমাকে একা রেখে বাসার সবাই যাবে?
-সব আয়োজন হয়ে গেসে না? মাইক্রো ভাড়া করসে?
-হু।
-খাবার দাবারের অর্ডার দেয়া হইসে?
-হু
-তাইলে নিশ্চিন্ত থাক। তোর জন্যে এতগুলা টাকা গচ্চা দিবে না। লাস্ট মোমেন্টে খালি কইবি যে তোর পেট মুচড়াইতাসে, একেবারে লাস্ট মোমেন্টে, বুঝছোস?
-বলব তো, দেখা যাক এখন কী হয়...


স্পিন

গাজীপুরের সবুজে সুশোভিত বনভোজন এলাকায় যাবার জন্যে বেশ ভালোই আয়োজন করা হয়েছে। শুধু নেহালের বাবা-মা-ভাই-বোন না, তার এক মামাও নিমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত আগের রাতে। ফুটফুটে চেহারার নেহালের প্রতি স্নেহ প্রদর্শনের পর যখন তিনি কথায় কথায় জানতে পারলেন যে, সে অফ স্পিন বোলিংয়ে ভালো করার জন্যে বিশেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, প্রাক্তন খেলোয়াড়ী জীবনের কথা স্মরণ করে তিনি তাকে কিছু টিপস দেবার জন্যে কাছে টেনে নিলেন।
-অফ স্পিন কীভাবে কর তুমি নেহাল, ফিঙ্গার দিয়ে নাকি রিস্ট দিয়ে?
-রিস্ট।
-সেটাই ভালো। তোমার বল টার্ন করে কেমন?
-টার্ন করে ভালোই। তবে টার্ন করাতে গিয়ে লাইন লেনথ ঠিক থাকে না।
-সবসময় টার্ন করাতে গেলে কিন্তু ব্যাটসম্যান বুঝে ফেলবে তোমার বল। মাঝেমধ্যে "আর্মবল" করবা। আর্মবল বোঝো তো?
-না মামা।
তিনি যত্নের সাথে তাকে আর্ম বল, টপ স্পিন সহ আরো কিছু বোলিং কৌশলের কথা জানালেন। কব্জির কিছু কৌশল হাতেকলমে শিখিয়েও দিলেন। আগামীকাল যাবার পথে ব্যাটবল কিনে নিয়ে গিয়ে কত মজা করে ক্রিকেট খেলা যাবে তার লোভনীয় বর্ণনা দিলেন। একজন মোটামুটি পরিচিত প্রাক্তন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে হাতেকলমে শেখার লোভে নেহালের চোখ চকচক করে উঠলো।
-এখন তাহলে যাও ঘুমাও। কালকে তো সকালে উঠতে হবে।

স্পিন বোলিংটা ভালোভাবে শেখার এই মওকা ছাড়া ঠিক হবে না, নেহাল ঠিক করে। নির্ঝর আর নিশাতকে একটা কিছু বুঝিয়ে দিলেই হবে। "স্যরি দোস্ত কোনভাবেই ম্যানেজ করতে পারলাম না। মামাটা এসেই যা ঝামেলা বাঁধালো।" প্রথমে সে প্রথাগত বোলিং করবে, বল অফস্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করে হালকা বাঁক নিয়ে ভেতরে ঢুকবে। ওরা হয়তো এই বলকে পাত্তাই দিবে না। সুইপ করে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে দেবে। এরপর সে আরেকটু বাঁক খাওয়াবে বলটাকে। তারা ডিফেন্স করতে বাধ্য হবে। তারপর সেই বিভ্রান্তিকর আর্মার! এটা অবশ্য এখনও ভালোমত দেয়া শেখেনি সে। তবে শিখে নেবে। কালকেই। তাকে ক্লাশটিমের অপরিহার্য সদস্য হতেই হবে। কতদিন আর দুধভাত হয়ে থাকা যায়! তারপর দেবে সে টপস্পিন। তারপর দুসরা...

-এই নেহাল, উঠবি না? তাড়াতাড়ি ওঠ। উঠে দাঁত মেজে বাথরুম টাথরুম সেরে রেডি হ! সময় নাই তো বেশি।

মাঝেমধ্যে "প্রকৃতি" মানুষকে নিয়ে বিচিত্র খেলা খেলে। টয়লেটে বসে নেহাল আবিস্কার করল, যে কথাটা তাকে বলার জন্যে এতদিন ধরে নিশাত এবং নির্ঝর পীড়াপীড়ি করেছে, যা নিয়ে সে দোনোমনা করে ভেবেছিলো শেষতক বন্ধুদের কথামতই কাজ করবে, গতরাতে মামার প্রলোভনে যা আবার ব্যাকস্পিন করে ফেরত এসেছিলো এবং সে প্রথম সিদ্ধান্তেই অটল হয়েছিলো, এখন তা আবার স্পিন করে নির্ঝর আর নিশাতের কাছেই ফেরত গেল। বল এখন তাদের হাতে। ইচ্ছেমত স্পিন করাচ্ছে যেন তার পেটের ভেতরেই! সব মুচড়ে মুচড়ে উঠছে।
-আমি যেতে পারবো না মা। আমার পেটখারাপ হয়েছে।
কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল সে।
-সে কী! কখন? কালকে রাতে বললাম এত করে চটপটি খাসনা, তা তো শুনলি না।
আনন্দের আয়োজন ভেস্তে যাওয়ায় বেচারা বালক ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদতে লাগলো।
-তোমরা যাও মা। আমার কারণে সবাই কেন মিস করবা? নিশাত আর নির্ঝরকে ফোন করে বলে দিচ্ছি আমি। ওরা এসে থাকবে। কোন সমস্যা হবে না।
-আহারে বাচ্চাটা আমার! ওরা যাক, আমি থাকি।


গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। ব্যাগ গোছানো শেষ। নিশাত আর নির্ঝরও এসে পড়েছে যথাসময়ে।
-আন্টি আপনি যান। আমরা থাকতে কোন সমস্যা নাই।
-বাবারা, তোমরাও তো বাচ্চামানুষ, ভরসা পাইনা।
-আরে আন্টি কী যে বলেন! আমাদের বয়স তের!
তের বছর বয়সের স্পর্ধিত এবং আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ শুনে আশান্বিত হয়ে না, বরং পুত্রকে স্বনির্ভর করার মহৎ প্রয়াসের কথা বিবেচনা করে অবশেষে নেহালের বাবা-মা তাকে অভিভাবকহীন একটা দিন ফাঁকা বাসায় মঞ্জুর করলেন।

-তোর দেখি সত্যিই পেট খারাপ হইসে! কস কী! আচ্ছা মন খারাপ করিস না। দেখ না কী আনসি!
নির্ঝর তার পকেট থেকে একটা সেলফোন বের করে। কোথা থেকে যোগাড় করেছে কে জানে! তাদের কাউকে এখনও সেলফোন রাখার অনুমোদন দেয়া হয়নি বাসা থেকে।
-আজকে ভিডিও করমু বুঝছোস? হিডেন ক্যাম ভিডিওর যা দাম! বেচলে ম্যালা টেকা পাওয়া যাইবো। আমার লাইনঘাট আছে।
তের বছর বয়সী বালকের দল জীবনের প্রথম জীবন্ত নগ্ন নারীদেহ প্রত্যক্ষন এবং সম্ভাব্য ব্যবসায়িক লাভের কথা ভেবে উত্তেজিত সময় কাটায়।
-কয়টা বাজে? দেখ আবার মিস হয়ে না যায়।
ইতিমধ্যে প্রচুর পরিমাণ পর্ন ক্লিপ দেখে নেহাল গাজীপুরে যাবার দুঃখ ভুলে গেছে। সে নিজেও অধৈর্য্য বোধ করছে। আজ তো অন্যান্য দিনের মত শুধু স্নান অবলোকন না, তার ভিডিও ধারণ করা হবে। সে যখন চাই তখন সেলফোনের ছোট্ট মনিটরে একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য স্বর্গীয় জলজ সৌন্দর্য দেখতে পারবে।
-মিস হবে না। আমি চোখ রাখছি।

অপেক্ষার প্রহর কেটে যায়। ধীরে ধীরে তাদের প্রগলভ মনোভাব সহিংস হয়ে ওঠে।
-মাগীটার কি হইল আইজকা? আহেনা কেন?
-দাঁড়া দেখি কী ব্যাপার। একটু চক্কর দিয়ে আসি বাসাটার সামনে থেকে।
-যা যা! তাড়াতাড়ি যা।
নেহাল গিয়ে যা দেখলো তা হতাশাজনক। বাসায় তালা মারা। উত্তেজনার আতিশয্যে তালজ্ঞান না হারালে এতক্ষণে ঠিকই দেখতে পেত জানালাগুলোও সকাল থেকে বন্ধই ছিলো। একবারও খোলা হয়নি। ফেলুদা, শার্লক হোমস এবং কিশোর পাশা পড়ে অর্জিত বর্ধিত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কাজে আসলো না কারোই।
-ওদের বাসায় কেউ নাই।
-এইটা কী বললি! এতক্ষণ আমাদের বসায় রেখে তুই এই কাহিনী শুনাইলি? গাধা! এই নির্ঝর, চল যাই গা।
-যাবি মানে? তোরা কেমন বন্ধু হ্যাঁ? আমি একা একা বাসায় কী করব? আমি না অসুস্থ? তোদের সাথে আমার আড়ি। তোরা আর কথা বলবিনা আমার সাথে।
বাস্পরূদ্ধ কন্ঠ থেকে অভিমানী অনুনয়ে নেহাল তার বন্ধুদেরকে নিখুঁত একটা টপস্পিন দিয়ে ঘায়েল করে ফেলে।
বাকি সময়টা তারা যকের ধন, টিনটিন, জেমস বন্ড, পর্ন, আজকের ব্যর্থ অভিযানের জন্যে খিস্তি, নতুন গোয়েন্দা পরিকল্পনা, দল গঠন এবং পুনরায় ফাঁকা বাসায় পূর্ণস্নান দেখার অভিসন্ধি করে কাটিয়ে দেয়।

বন্ধন

-আমার সুইট বেবিটা! তুমি ঠিক ছিলে তো বাবা?
-হু মা। তোমরা কেমন মজা করলা?
-আর মজা! আমি তো তোমাকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির ছিলাম। এজন্যেই তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
-থ্যাংকিউ মা।
-এখন শরীর ভালো?
-হ্যাঁ, ভালো।
-পাশের বাসা থেকে এত কান্নার শব্দ কিসের! দাঁড়াও তো দেখে আসি।

ঘটনা খুব বিশেষ কিছু না। স্নানকন্যা আত্মহত্যা করেছে। শুনে নেহালের কোমল মন খুবই বেদনার্ত হল। দৈনিক গোপন বিনোদনের সরবরাহ বন্ধ হবার জন্যে না, তার বন্ধুদের নিয়ে তৈরি হিডেন ক্যাম ভিডিও উচ্চদরে বাজারজাত করার প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যাবার 'ব্যবসায়িক' ক্ষতির জন্যেও না, মেয়েটির জন্যে তার বালকমন কেঁদে উঠলো অন্তরের গভীর থেকেই। কান্না লুকোনোর চেষ্টা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলে সে নিজেকে খুঁজে পায় বাবা-মার নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। তাদের আদর, স্পর্শ এবং সান্তনাবাণীতে তার মোলায়েম মনের ক্ষত সারাতে চেষ্টা করা হয়, এবং এত কম বয়সে মৃত্যু অবলোকনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তার ভবিষ্যতে কীরকম মানসিক চাপ ফেলবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

-এরকম একটা ইনসিডেন্ট চোখের সামনে। ইশ!
-মেয়েটাকে চিনতা তুমি?
-তেমন না। দুই একবার কথা হয়েছিলো।
-নেহাল খুব আপসেট হয়ে গেছে। এই বয়সে এমন একটা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়াটা খুব বাজে অভিজ্ঞতা। তুমি যাওগে ওর কাছে। আমি খবরটা দেখি।

নেহালের মা আবারও তার কাছে ফিরে গিয়ে মৃত্যু এবং জগতের অনিত্যতা বিষয়ক ব্যাপারগুলি কতটা প্রশান্তিময়, অথবা নিয়তির সাথে কীভাবে আবর্তিত সে সম্পর্কিত সুললিত বাণীর মাধ্যমে তার আঘাতপ্রাপ্ত মনের ক্ষত উপশমের চেষ্টা করেন। পর্যাপ্ত পরিমাণ সান্তনা দেবার পর তিনি ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলে তার মনকে অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা চালান।
-আজকে তোরা সারাদিন কী করলি? নির্ঝর আর নিশাতের সাথে খুব মজা হয়েছে, না?
-নাহ, মজা আর তেমন কই হল!
-কেনরে বাবা, শরীর বেশি খারাপ ছিলো?
-না।
-তাহলে? তোরা একসাথে হলে তো নরক গুলজার করে ফেলিস। মন খারাপ ছিলো?
-না ঠিক মন খারাপ না, মেজাজটা একটু খারাপ ছিলো।
-ওরে আমার মেজাজী ছেলে রে! বন্ধুদের সাথে ঝগড়া করবি না বুঝলি? ওরা তো খুব ভালো ছেলে।
-হু। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। মা তুমি এখন যাও, আমি টিভিতে অফ স্পিন কোচিং ক্লাশ দেখবো।
-আচ্ছা দ্যাখ।

ছেলের মন ভালো হয়ে গেছে, মনোরঞ্জনের রসদ খুঁজে পেয়েছে বুঝতে পেরে মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন


শুধু যদি তারা নেহালের মনোরঞ্জনের ব্যাপ্তিটা আরো ভালোভাবে জানতো! হয়তোবা তাদের শঙ্কাটা কমত এই ভেবে, যে ছেলে তো ম্যাচিওর্ড হয়ে উঠছে, অথবা তারা ক্ষিপ্ত হত এই বয়সেই তার নৈতিক স্খলন শুরু হওয়ায়। তবে আগামীকাল যখন তারা জানবে যে মেয়েটির আত্মহত্যা করার কারণ একটি হিডেনক্যাম ভিডিও, যে ভিডিওটা তার ছেলের রেকর্ডকৃত হতে পারতো ঘটনা পরম্পরা অল্প একটু এদিক ওদিক হলে...নাহ অভিভাবকদের এত কিছু জানতে নেই।



আর যদি জেনেও থাকে, এত অল্প বয়েসী সুইট বেবিটাকে তারা নিশ্চয়ই অযাচিত কোন শাস্তি দিতে পারবে না। বার-তের বছর বয়সী একটা ছেলে কতটুকুই বা বোঝে?

প্রথম প্রকাশ- somewhereinblog

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মুভি রিভিউ 'মাদার' এ্যারোনোফস্কির মেইনস্ট্রিম ওয়ান্ডার!

জ্বী না, সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়!