কঠিন পৃথিবী এবং অমায়িক ফেসবুক


নানা কারণে জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে এ জীবন আর রাখবোনা। সিদ্ধান্ত নেয়া পরবর্তী সংকটকাল কিভাবে সামলানো যায় তাই ভাবছিলাম। কারণ সবাই নিশ্চয়ই খুব সিনক্রিয়েট করবে, চোখের পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আমাকে এহেন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু এসবই তো বৃথা। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, এখন শুধু বাস্তবায়ন করাটাই বাকি। কিন্তু অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে কারো কোন মাথাব্যথাই নেই এ নিয়ে। সবাই আমার সামনে দিয়ে হাঁটছে, খাচ্ছে, চুল আঁচড়াচ্ছে, সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, কিন্তু একটিবারের জন্যেও কেউ বললনা যে.."যেওনা সাথী..(আর পারিনা)"। অবশ্য সিদ্ধান্তটার কথা আমি কাউকে জানাইনি। একটু ভয় ভয় লাগছিলো। এর আগে এসব কথা বলতে গিয়ে ঝাড়ি খেতে হয়েছিলো। মরার আগে কে ঝাড়ি খেতে চায় বলেন? মরার আগে তো শুনেছি একটা ফাঁসির আসামীকেও ভালোমন্দ খেতে দেয়া হয় আর আমি মরব ঝাড়ি খেয়ে? নো ওয়ে। এইবার আমি সিরিয়াস, এইবার দেখি কে ঠেকায়! এরকম দৃঢ় পণ করার পরেও দেখলাম যে কারো মধ্যে কোন ভাবান্তর নেই। কেউ কি চোখের ভাষা পড়তে পারেনা? পৃথিবী এত নিষ্ঠুর! ঠিক আছে, নিষ্ঠুর পৃথিবী, আমি থোড়াই কেয়ার করি। ওরে কে আছিস দু পাতা ফেনোবারবিটান..না থাক কারো সাহায্য লাগবেনা!

নিষ্ঠুর পৃথিবীকে অনানুষ্ঠানিক বিদায় জানানোর পরে শেষবারের মত ইন্টারনেটে বসলাম। এখানে সেখানে অনেক একাউন্ট আছে, ওগুলো বন্ধ করে দিই। প্রথমেই ঢুকলাম ফেসবুকে। এই ব্যাটা খুব জ্বালিয়েছে। মাঝে মাঝেই এ ধরনের  নোটিফিকেশন পাঠাতো যে তারা নাকি আমার জন্যে পারফেক্ট ম্যাচ খুঁজে পেয়েছে, কিংবা কে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে তারা নাকি জানে। আমি যাচাই করতে গিয়ে দেখেছি, সবই মিথ্যে! একবারতো একটা এ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার
করে জানতে পারলাম যে "অমুক" নাকি আমার জন্যে গোপনে অশ্রুবর্ষণ করে। তো আমি তাকে কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেবার মহান অভিপ্রায়ে জানালাম যে, আর চোখের পানি ফেলার দরকার নেই, আমি এসে গেছি। কিন্তু তখন তো আর বুঝিনি যে আমি ফেঁসে গেছি!
"মানে, কি বলতে চান আপনি? এসে গেছেন মানে? আপনাকে কে আসতে বলেছে? এক্ষুণি বিদেয় হোন এসব ফুল টুল নিয়ে। এহ আবার লাল টকটকে টাই পরে এসেছে লাল গোলাপের সাথে ম্যাচ করে..যত্তসব আবুল...."
জীবনের শেষমুহূর্তে এসে আমার সেই অপমানের কথা মনে পড়ল। আজ ফেসবুকের একদিন কি আমার একদিন! আমি সরোষে একাউন্ট ডিএ্যাকটিভেট করার প্রক্রিয়া শুরু করার জন্যে প্রস্তুত হলাম। খুব একটু জটিল মনে হলনা প্রক্রিয়াটা। ঐতো ডিএ্যাকটিভেট বাটন। টিপে দিলেই শেষ। কিন্তু এ কি! প্রথমেই তারা আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করল কয়েকজনের ছবি দিয়ে যে, তারা নাকি আমাকে খুব মিস করবে। এটা দেখে ভালো লাগলো। জীবনটা মনে হয় আবার নতুনভাবে শুরু করা যায়। যাক.......আচ্ছা! আচ্ছা!! আচ্ছা!!!ফেসবুক জানলো কিভাবে যে ওরা আমাকে মিস করবে? কেউ তো জীবনেও একটা ফোন করেও খবর নেয়না। আমি অত্যন্ত চতুরতার সাথে চালাকিটা ধরে ফেললাম। নাহ, এবার আর কোনকিছুতেই কাজ হবেনা। ফেসবুকের মিথ্যেবাজি আমি ধরে ফেলেছি। ছবিগুলোর দিকে শেষবারের মত প্রবল তাচ্ছ্যিল্যের সাথে তাকিয়ে আমি পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হলাম।
সেখানে তারা আমার কাছে জানতে চাইছে আমি কেন ফেসবুক ডিএ্যাকটিভেট করছি। আরে কি ঝামেলা! বাধ্য হয়ে প্রশ্ন গুলির উত্তর দিতে হল।
প্রথমেই তারা অত্যন্ত বিনয়ের(নিশ্চিত মেকি) জানতে চাইলো, আমি কি এখানে নিরাপদ বোধ করছিনা? অত্যন্ত আন্তরিক প্রশ্ন। এভাবে কেউ কখনও জিজ্ঞেস করেনি। আমার নিরাপত্তার অভাবের কথা জেনে তারা আমাকে অমায়িকভাবে বর্ণনা করল কিভাবে আমার এই ভার্চুয়াল জগৎকে নিরাপদ রাখতে পারি। যেখানে জীবনের প্রতিই আমি বীতশ্রদ্ধ সেখানে সেখানে ভার্চুয়াল জগৎতো কোন ছাড়! অত্যন্ত বিরক্তির (সম্ভবত মেকি!) সাথে পরের ধাপে গিয়ে জানতে পারলাম যে তারা আমার প্রাইভেসি নিয়েও সচেতন, এবং এ ব্যাপারে একটি দীর্ঘ বয়ান দিলো আমাকে। আহা! এভাবে যদি সবাই আমাকে নিয়ে ভাবতো! তাহলেতো আমাকে আজ এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতনা! মনটা নরম হয়ে গেল আমার। কিন্তু সিদ্ধান্ততো নেয়া হয়েই গেছে। এখন এটা থেকে পিছু হটা কি ঠিক হবে?(কনফিউশন)। এরপরে, তারা আমাকে এর সহজবোধ্যতা, অপচয়প্রবণতা থেকে বাঁচার উপায়, বিরক্তিকর নোটিফিকেশন থেকে মুক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি সম্পর্কে নানারকম যুক্তি দেখালো, তাও যেন আমি না যাই! জীবনসায়াহ্নে এসে এরূপ আপ্যায়নে কিছুটা আদ্র হয়ে উঠলো মন। তা হোক। আমি ওসব এড়িয়ে গিয়ে শেষ বাটনটায় ক্লিক করতে গেলাম। ওখানে ওদেরকে আশ্বাসবাণী দিতে হয় যে, এটা চিরস্থায়ী না, আমি আবার ফিরে আসবো। এবার আর তারা কোনরকম আপত্তি করলনা। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আমি আবার আসবো জেনে। বারবার স্মরণ করিয়ে দিলো, আমি একাউন্ট স্থগিত করার পরে যেকোন সময় লগ ইন করেই আবার সেটাকে সচল করতে পারবো। কিছু শুভকামনাও জানালো।
আমার আর যাওয়া হলনা! ফেসবুকের অমায়িকতায় আমি মুগ্ধ হলাম! তার ভার্চুয়াল মনটা আসলেই ভালো। হয়তো বা তা মেকি, কিন্তু বাস্তব জীবনেও সেটাই বা কে দেখায়! একাকী যুবকের নিঃসঙ্গতার করুণ উপাখ্যানে সেই ঢেঢ়। থাকুকনা এতটুকু কৃত্রিমতা, বা পুরোটাই... ভার্চুয়াল বা রিয়্যাল লাইফে। আমাদের এই তো অবলম্বন এখন...

এটা ভালো লাগলে পড়তে পারেন ছহি রকেট সায়েন্স শিক্ষা

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মুভি রিভিউ 'মাদার' এ্যারোনোফস্কির মেইনস্ট্রিম ওয়ান্ডার!

জ্বী না, সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়!