ঝিমঝিমপুর হুংকারবাদ
(১)
ঝিমঝিমপুরের অধিবাসীরা আজ অত্যন্ত উৎকণ্ঠা মিশ্রিত আনন্দের দোলায় দুলছে। তাদের অনেক দিনের সঞ্চিত আশার শিহরণ আজ বড় একটা বুদবুদে পরিণত হতে যাচ্ছে। অবশ্য এরকম হাওয়াই আশা তারা এর আগেও অনেক বার ধারণ করেছে। যথারীতি বুদবুদ তৈরি হয়ে ফুস করে ফেটেও গেছে। তাই বলে আশা করতে ছাড়ে নি তারা। এবারের ভবিতব্য ঘটনাটি নিয়ে নানারকম চমকপ্রদ গুঞ্জন শোনা গেছে অনেক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে। অবশ্য ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে এ সম্পর্কে স্পষ্ট কোন ইঙ্গিত দিতে পারে নি কেউ। অমুকের মামাশ্বশুরের দুঃসম্পর্কের জ্যাঠতুতো ভাই যদি ৩ ক্রোশ পথ পেরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে যে হারপুন দিয়ে হাঙ্গর ধরার স্থগিতাদেশ বাতিল হচ্ছে, তো তমুকের প্রাক্তন কলিগের বর্তমান প্রেমিকার দুলাভাই পাকা খবর নিয়ে আসে যে গাঁজাকে বৈধ করা হচ্ছে। সুতরাং, যে ঘোষণাই আসুক না কেন কিছুটা ভালো তো হবেই! হাঙ্গরের ডানার স্যুপ অতি সুস্বাদু। গাঁজা একটি যথার্থ পেইনকিলার। তাহলে, ক্ষতি কী! এমন কী এও শোনা গেছে যে ‘স্পিড মানি’তে নাকি প্রপেলার লাগানোর ব্যবস্থা হচ্ছে! ঝিমঝিমপুরের অধিবাসীদের তাই উত্তেজিত হবার কারণ আছে বৈ কি! আজ টেলিভিশন এবং রেডিওতে একযোগে প্রচারিত হবে প্রেসিডেন্টের ভাষণ। এর আগে কখনো এমন ঘটা করে কোন ভাষণের ‘ট্রেইলার’ দেখানো হয় নি। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা, কখন যে সন্ধ্যা সাতটা বাজবে!
(২)
...তো আজ যে সবাই তাড়াতাড়ি কাজ সেরে যথা সময়ে বাসায় পৌঁছে সাগ্রহে টিভির সামনে বসবে তাতে আর সংশয় কি! দশটা না পাঁচটা না, একটা মোটে প্রেসিডেন্ট তাদের। তার কখন কী খায়েশ হচ্ছে তা উজির-নাজির-প্রজা-গজাদের না জানলে চলবে কীভাবে? হাজার হোক, সচেতন নাগরিক বলে কথা! রাষ্ট্রযন্ত্রও এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেষ্ট। সবাই যেন কাজ সেরে যথা সময়ে বাসায় পৌঁছে ভাষণ শুনতে পারে, তাই তাদের তত্ত্বাবধানের জন্যে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণ করতে বড় শহর গুলোতে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তাদের আচরণ বেশ রূঢ়। তবে এটুকু সহ্য করে নিতে পারবে নগরবাসী। এমন সুদিন তো সচরাচর আসে না! তাই খানিকটা পেটে গুঁতো, পিঠে চাটি, কানে গালি, চোখে টিয়ার শেল সহ্য করে নিতে নিশ্চয়ই তারা বাগাড়ম্বর করবে না। সচেতন নাগরিকেরা নিশ্চয়ই তাদের জন্যে জান কোরবান করে দেয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি অনুগত। তাদের কে তো আর গুলি করে মেরে ফেলা হচ্ছে না! এত ছাড় আর কোথায় পাবে?
কিন্তু অরিন পড়ে গেছে বিপদে। কেন, কীভাবে, কোথায় বিপদে পড়েছে জানতে হলে ঝিমঝিমপুরের আইন এবং বিচার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ক্রিয়েটিভ আইডিয়া সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। নইলে অতি শূদ্ধতাবাদীরা অযথাই “মানবাধিকার লঙ্ঘন”, “বর্বর আইন” ইত্যাদি বলে গলার রগ ছিঁড়ে ফেলতে পারে। এদের ব্যাপারে ঝিমঝিমপুরের বাসিন্দা এবং প্রশাসন, দুই’ই কঠোর। আর লোকগুলোও বিষম বোকাটে। তাদের চলা-ফেরার ঠিক নেই, বাস করে বিভ্রমের জগতে, মাঝেমধ্যেই তারা পুলিশ এবং মাস্তানদের মধ্যিকার গোলমালে পড়ে প্রাণ হারায়। প্রথম দিকে এ সমস্ত ঘটনার ফ্রিকুয়েন্সি এবং স্ট্রাকচারে ভীষণ গোলমাল ছিলো। এখন সেসব ঠিক করে নেয়া হয়েছে। ফলে অযথা প্রশ্ন উত্থাপনকারীরাও একই পরিণতি বরণ করলে তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা অতি সঙ্গোপনে হয়তো বা আধা ফোঁটা জল বিসর্জন করতে পারে, এর পর যদি তা ভুলে না যায়, তাহলে অনাকাঙ্খিত পরিণতির জন্যে রাষ্ট্রযন্ত্র কোনভাবেই দায়ী নয় বলে আগেই সাবধান করে দেয়া হয়েছে।
ও আচ্ছা, অরিনের প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিলো...
(৩)
অরিন। উচ্চতা ৫-২। ওজন ৫২ কেজি। গায়ের রঙ শ্যামলা। কালো চোখ এবং চুল। বয়স ১৭। ভরাট বুক। সুডৌল নিতম্ব। সে এসেছিলো ঝিমঝিমপুর ধর্ষণ ইন্সটিটিউটের ত্রৈমাসিক বাধ্যতামূলক মহড়ায় শামিল হতে। বলে রাখা ভালো, এই অতি আবশ্যক রাষ্ট্রীয় কার্যটি প্রতিটি বালেগ নারীর জন্যে বাধ্যতামূলক। নয় অতি শীত এবং ঈষদুষ্ণ দেশ হওয়ায় এখানকার নারী রা অল্প বয়সেই পূর্ণাঙ্গ নারী হবার জটিল শারীরিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়। সেটির গড় বয়স ১২-১৩। তারপরেও রাষ্ট্রের অসাধারণ বিবেচনা বোধ এবং প্রজ্ঞার ফলে মেয়েদের জন্যে বয়সটি নির্ধারিত হয় পনের! মহানুভবতার এমন বিরল উদাহরণ স্থাপন করায় দেশের মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি উচ্ছসিত প্রশংসা বর্ষণ করে। অবশ্য বাইরের বিশ্বে এসব নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ বিদ্যমান। সেটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার মত গাটস এই রাষ্ট্রের আছে। রাষ্ট্রের এই অতি পুরুষালী আচরণে এমন কী মেনোপজের পাল্লায় পড়া ভদ্রমহিলা গণও পরম তৃপ্তি লাভ করে বলে মিথ প্রচলিত আছে।
মাঝে একবার ঝিমঝিমপুরে ধর্ষণ অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেলো। কেউ রক্ষা পাচ্ছিলো না। ৩ বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা, কেউ না। আর ধর্ষণের সাথে যুক্ত ছিলো সমগ্র পুরুষ জাতি। ১৫-থেকে ৬৫, ব্যয়ামবীর থেকে হাঁপানি রোগী, খেলোয়াড় থেকে বাসের কন্ডাকটর, মোদ্দাকথা সক্ষম সবাই নিযুক্ত ছিলো এই উৎসবে। ধর্ষণ হচ্ছিলো পথে ঘাটে, বাসে বাজারে, স্কুলে অফিসে, রান্নাঘরে-ব্যালকনিতে। যারা অতিশয় বৃদ্ধ অথবা অক্ষম, অথবা বোকা, তারা এর বিপক্ষে নিজেদের প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মার খাচ্ছিলো বারবার। ধর্ষিতার পোষাক, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ধর্ষকদের সঠিক পরিচর্যার অভাব, ইত্যাদি কনফ্লিক্টে বিচার ছিলো সুদূর পরাহত। অবস্থা বেগতিক হলে পরে প্রশাসন দয়া পরবশ হয়ে উদ্যোগ নেয়। উদ্যোগটি ছিলো সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এবং উদ্ভট ধরণের মৌলিক।
যেহেতু ধর্ষিত হওয়াটাই নিয়তি সুতরাং...আরে না না, সেই প্রাচীন ডায়ালগের মত উপভোগ করার মন্ত্র দেয়া হয় নি। নেয়া হলো বিজ্ঞানসম্মত একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রতিটি জেলায় একটি করে ধর্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হলো। বয়স পনের হবার সাথে সাথে একজন মেয়ে ধর্ষিত হবার উপযোগী বলে বিবেচিত হবে, এবং তাকে প্রতি তিন মাসে একবার সেখানে গিয়ে ধর্ষিত হতে হবে। ছাত্র সংগঠন থেকে বাছা বাছা কিছু জোয়ান পান্ডাকে নিয়োগ দেয়া হলো ধর্ষক হিসেবে। বলা বাহুল্য, এই পদের জন্যে হন্যে হয়ে পড়লো পুরুষ সকল। এই পরিস্থিতি অত্যন্ত কৌশলে সামাল দেয়া হলো। বয়স, পেশা এবং সুস্থতার ভিত্তিতে অসংখ্য কোটা অন্তর্ভুক্ত করলেন তারা। যেমন সিএনজি ড্রাইভার কোটা, অবসরপ্রাপ্ত ছাত্রনেতা কোটা, এইডস রোগী কোটা ইত্যাদি।
প্রণয়ন করা হলো জাতীয় ধর্ষণ নীতিমালা। সে এক এলাহী কারবার! বিশাল এক বই। তার থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ এখানে উপস্থাপন করা হলো,
#ধর্ষণ করার সময় ভায়োলেন্স কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। তবে ধর্ষিতা যদি অবাধ্য হয়, এবং আঘাত করতে উদ্যত থাকে, তবে তাকে খুন করা যেতে পারে। (খুন করার নিয়মাবলী জানতে লক্ষ্য করুন সংযুক্তি ‘ক’।)
# যদি তার বিরুদ্ধে ধর্ষকের চাহিদা অনুযায়ী একাধিক আসন গ্রহণ না করার অভিযোগ আসে, তবে তার বিরুদ্ধে গণধর্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
# ফোর প্লে বা শৃঙ্গার অবশ্যই দুই মিনিটের বেশি হওয়া যাবে না। এর অন্যথা হলে ধর্ষকের রেন্ডিটি কার্ড (রেপ আইডেন্টিটি কার্ড) বাতিল করা হবে)।
# প্রতিটি পুরুষের জন্যে কনডম এবং নারীর জন্যে পিল বাধ্যতামূলক।
# যদি নির্দিষ্ট তারিখে উদ্দিষ্ট নারীর ঋতুস্রাব চলে, তাহলে তাকে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনের আপত্তিপত্র (একজন সামরিক পেটোয়া অফিসার, একজন সরকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা, এবং একজন ধর্মীয় নেতা দ্বারা সত্যায়িত) জমা দিতে হবে।
ইত্যাদি।
এর ফলে ধর্ষণজনিত আঘাত, অসুখ এবং অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ লক্ষ্যনীয় ভাবে কমে আসে।
তবে কিছু বোকা মেয়ে এত সুন্দর সিস্টেম থাকা স্বত্ত্বেও স্রেফ নিজেদের অসচেতনতার কারণে ভোগান্তির সম্মুখীন হয়। এবার ফেরা যাক অরিনের প্রসঙ্গে। নির্দিষ্ট দিনে সে ঠিকই উপস্থিত হলো, কিন্তু তার পিরিয়ড চলা স্বত্ত্বেও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় বিপাকে পড়লো।
(৪)
-বিশ্বাস করুন, আমার এইমাত্র পিরিয়ড শুরু হলো। আমি আগে থেকে ধারণা করতে পারি নি। তাই কাগজপত্র আনা সম্ভব হয় নি।
-আপনার পিরিয়ড কবে হবে সেই হিসেব রাখেন না? কেমন সচেতন নাগরিক আপনি? আপনাদের মত কুঁড়েরাই এ দেশের প্রধান শত্রু। কেন, আপনি জানতেন না, পিরিয়ড শুরু না হলেও শুরু হবার সম্ভাব্য ±১০ দিন হিসেব করে কাগজ-পত্র রাখতে হয়?
-স্য...স্যরি। আমি জানতাম না এই নিয়ম।
-এখন কিছু করার নেই। এক হাজার মুদ্রা জরিমানা দিন, নয়তো দশ দিনের হাজত বাস করুন।
-প্লিজ প্লিজ! দেখুন না কিছু করা যায় কি না!
-না কিচ্ছু করার নেই।
-আমি আমাদের এলাকায় গিয়ে কমিশনারের কাছ থেকে কাগজ নিয়ে আসি? বেশিক্ষণ লাগবে না। বড়জোর ১ ঘন্টা। প্লিজ আমাকে সুযোগটা দিন।
-আপনার কাছে টাকা নেই?
-না নেই।
-যে জায়গা থেকে এসেছেন, সেখানে গিয়ে আবার ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যাবে।
-কিন্তু এই অফিস না রাত আটটা পর্যন্ত খোলা থাকে?
-আপনি কিছুই জানেন না দেখছি! আছেন কোথায়? আজ সন্ধ্যা সাতটার সময় প্রেসিডেন্ট ভাষণ দেবেন, জানেন না? এইবার দারুণ কিছুর ঘোষণা আসবে সবাই বলাবলি করছে।
-শেষ বারের ভাষণে কি দারুন কিছু এসেছিলো?
-আপনি কি মহামান্য প্রেসিডেন্টকে চার্জ করছেন?
-সে কি! এ কেমন কথা! আমি চার্জ করবো কেন? অসম্ভব! এ হতেই পারে না। জাস্ট একটা ভুল বোঝাবুঝি। প্লিজ...
-আপনি অসংলগ্ন আচরণ করছেন। আপনার সাথে কথা বলা বৃথা। এখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। আর আধা ঘন্টার মধ্যে টাকা অথবা কাগজপত্র যোগাড় করুন, নাইলে জেলে যান। সোজা কথা। নেক্সট কে আছেন? এদিকে আসুন।
(৫)
অরিন কে নিয়ে কি আর কোন আলোচনার প্রয়োজন আছে? সে তার কর্মফল ভোগ করুক। তাকে নিয়ে আপনার মাথা না ঘামালেও চলবে। ভাষণ শুরু হতে আর বেশি দেরি নেই। টেলিভিশন বা রেডিও টিউন করতে থাকুন। ভাষণ সংক্রান্ত গুজব এবং গালগপ্প ইতিমধ্যেই সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে! প্রতিটি বাড়িতে, অফিসে, স্কুলে, কলেজে, ভার্সিটিতে, বাসস্টপে, রেলস্টেশনে, ওভারব্রিজের চিপায়, আন্ডারপাসের আধো আঁধারে উচ্চারিত হচ্ছে প্রেসিডেন্টের নাম। তাকে নিয়ে শ্লোগান দেয়া হচ্ছে, আগাম উৎসব শুরু করেছে মানুষজন। বিভিন্ন জায়গায় জায়ান্ট টিভি ক্যামেরা তৎপর।
-সুধী মন্ডলী, শুভেচ্ছা সকলকে। আপনারা সবাই জানেন আজ একটি বিশেষ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের মাননীয় প্রেসিডেন্ট আজ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। উপলক্ষ্য? তিনি আগেই জানিয়েছেন বিশেষ একটি যুগান্তকারী ঘোষণা আসছে, যা বদলে দেবে আমাদের জীবনধারা। এ দেশের মানুষ বরাবরই আমাদের মহামান্য প্রেসিডেন্টকে প্রাণ নিংড়ানো সমর্থন দিয়ে এসেছেন। অপশক্তিদের নির্মম ভাবে প্রতিরোধ করে দেশপ্রেমের অসাধারণ নজির রেখেছেন। এখন খুন, ধর্ষণ এবং অপহরণ সরকারী তত্ত্বাবধানে সুচারূ ভাবে পালিত হয়। ফলে অপরাধের মাত্রা শূন্যের কোঠায়। মানুষ জন সুখী এবং সন্তুষ্ট। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত, স্যরি ভুল উপমার জন্যে, সোনায় সোহাগার মত আজকে বিশেষ কোন একটা প্রাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে দেশের মানুষের, জন্যে। ঝিমঝিমপুরের মানুষের এটা প্রাপ্যই ছিলো। আসুন আমরা সমবেত জনতার মাঝ থেকে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নেই, কে কী ভাবছেন এই ঘোষণা সম্পর্কে।
(৬)
-আপনি কী করেন?
-শিক্ষকতা।
-আপনার কী মনে হয়? কেমন ঘোষণা আসলে আপনি খুশি হবেন?
-আমি খুশি হব যদি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সাথে নিয়োজিত শিক্ষকদের বিশেষ সম্মাননা পদক দেয়া হয়। কারণ তারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
-আপনি কী করেন?
- খেলোয়াড়।
-আপনার দাবী কী?
-দাবী? আপনার মাথা খারাপ না কি? জানেন না দাবী-দাওয়া পেশ করা একটি অপরাধ? আমাকে আপনি অসচেতন মানুষ ভাবেন না কি? আমি আইন মেনে চলা খাঁটি নাগরিক।
-স্যরি, আসলে একটু ট্রিক করলাম। তো বলুন আপনি কী ভাবছেন?
-আমি ভাবছি ডোপ পাপে ধরা পড়া খেলোয়াড়দের শাস্তি যদি মওকুফ করা হয়, তাহলে বেশ হবে।
-কথা বলছি একজন নাপিতের সাথে। আপনার ভাবনা বলুন।
-চুল কাটতে গিয়ে কর্তিত কান সমূহ দিয়ে একটি জাদুঘর করতে পারলে খুব ভালো হয়।
“দর্শক, আপনারা দেখছেন এই অভূতপূর্ব মিলনমেলা। আশা এবং স্বপ্নের, সাচ্ছন্দ্য এবং আনুগত্যের। আর মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকি। এরপরই আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমরা এখানে অনেকেরই সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আশ্চর্য হয়েছি সবার বহুমাত্রিক চাহিদার রূপ দেখে। যেন অবুঝ শিশু আবদার করছে অভিভাবকের কাছে। এমনই তো হওয়া উচিত! জনগণের জন্যে মহামান্য প্রেসিডেন্টের চেয়ে ভালো অভিভাবক আর কে রয়েছে এ দেশে? অবশ্য অনেকেই এর মাঝে ফোড়ন কাটতে পারে এই বলে, যে দেশের মানুষের মাঝে ঐক্য নেই বলে এই বহুমাত্রিক চাহিদা, কেউ কোন কিছুতে একমত হতে পারছে না ইত্যাদি। খুন করা হোক তাদের অতি নৃশংশ কায়দায়। ধর্ষণ করা হোক তাদের আত্মীয়দের। ইতিমধ্যেই এরকম বেশ কিছু দল এবং নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কী করা উচিত আমাদের এসএমএস করে জানান। (১) শিরকর্তন (২) আমরণ ধর্ষণ (৩) হস্তীপেষণ
লটারির মাধ্যমে বিজয়ী ৩ জন পাবেন ১০ গ্রাম করে কোকেন”
(৭)
সময় যত এগিয়ে আসতে লাগলো, মানুষের কৌতুহল ততই সীমা ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। আনন্দের আতিশয্যে তারা উশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। ভেঙে ফেলছে ব্যারিকেড। ঢিল মারছে পুলিশের গাড়িতে। টেনে ছিড়ে ফেলছে একে অপরের পোষাক। উপাসনালয়ে গিয়ে মল-মূত্র ত্যাগ করছে। খাবারের দোকান থেকে ইচ্ছেমত খাবার ছিনিয়ে নিয়ে খাচ্ছে। হস্তমৈথুন করছে প্রাচীন স্থাপনার ওপর। কেউ কারো চোখ গেলে দিচ্ছে। কেউ রড দিয়ে মাথায় বাড়ি মারছে। কেউ কুকুরের মত চার পায়ে ভর করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হুমকি দিচ্ছে একে অপরকে। কেউ নর্দমায় পড়ে গিয়ে স্নান করে নিচ্ছে সেখানেই। ওরা হাসছে, ওরা খেলছে, ওরা মারছে, ওরা মারা যাচ্ছে। তবুও ওরা আনন্দিত। কারণ, তারা জানে এত কিছু হবার পরেও সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কারণ, পরম ক্ষমতাবান মহান প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে এমন একটি উপায় বাতলে দিবেন যার ফলে মুছে যাবে সব দ্বিধা, ভয়, অসঙ্গতি, কলুষ, ক্লিশতা, অনৈক্য এবং এ্যানার্কি। ওরা ভুলে যাচ্ছে সময়ের ধারাপাত। অবুঝ রাগী সূর্যটা খামোখাই অভিমান করে হারিয়ে গেলো বিশ্ব চরাচরের কোন এক প্রান্তে। নেমে এলো অবিনশ্বর আঁধার। আর কিছুক্ষণ পরেই তিনি আসবেন। তার দরাজ কণ্ঠের অহমিকায় পথে পড়ে থাকা রক্ত নিয়ন সাইনের মত জ্বলে উঠবে। খণ্ডিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো জীবন্ত হয়ে অক্টোপাসের মত জড়িয়ে ধরবে মৃতদের শরীর। এক মর্মন্তুদ শোকপ্রকাশ এবং বিলাপে পরিশূদ্ধ হবে পাপ এবং অন্যায়ে রত নাগরিক শরীর। প্রচণ্ড শব্দসক্ষম স্পিকারে এইমাত্র ধ্বণিত হলো সেই বার্তা। তিনি আসছেন, তিনি আসছেন, তিনি আসছেন...
(৮)
তিনি এসেছেন সবুজ রঙের স্যুট পরে একদম ফুলবাবুটি সেজে। গ্রিনরুমে তার সাজসজ্জার পুনঃনিরীক্ষণ চলছে এখন। তার মধ্যে খেলা করছে এক আশ্চর্য প্রশান্তি। প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন তীব্র উত্তেজনার বলগে সেদ্ধ হওয়া, ফুটতে থাকা, রক্তাক্ত, পাঁচড়া এবং ফোঁড়ায় আক্রান্ত, পুঁতিগন্ধময় মানুষের দিকে। ঠিক এমনটাই তো তিনি চেয়েছিলেন আজকের জন্যে! তার ক্ষেত্র প্রস্তুত। তিনি আজ একটা জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন। যা ঠিকভাবে পালন করলে (অবশ্য ঠিক ভাবে পালন না করে উপায় আছে না কি! প্রেসিডেন্টের আদেশ বলে কথা!) মুছে যাবে সব বিভেদ, বর্ণবিদ্বেষ, এবং জাতিভেদ। ঝিমঝিমপুরের অবস্থা যেমন দাঁড়িয়েছে এই মুহূর্তে, এই যে অরাজকতা, সহিংসতা, অজস্র স্বত্তা, সবাইকে এক করার জন্যে এমন একটা ক্ষেত্রই তো দরকার! মহামান্য প্রেসিডেন্ট চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন। বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি একমাত্র তার কাছেই রয়েছে, ব্যাপারটা দারুণ উদ্দীপক। তিনি শেষবারের মত ভাষণের স্ক্রিপটায় চোখে বোলালেন।
(৯)
প্রিয় দেশবাসী,
দীর্ঘ চার বছর পর আপনাদের সাথে কথা বলার একটি উপলক্ষ্য তৈরি হলো। এটা নিঃসন্দেহে একটি আনন্দময় মুহূর্ত। এই চার বছরে আমি আপনাদের সামনে আসি নি। কারণ আসার দরকার পড়ে নি। সবকিছুই খুব ভালো ভাবে চলছে। কোথাও কোন অনিয়ম নেই। অপরাধের পরিমাণ শূন্যের কোঠায়। ধর্ষণ নেই। খুন খারাবি নেই। যারা সব নিয়ম কানুন মেনে চলেছেন, তাদের জন্যে অবারিত পুরষ্কারের হাত বাড়িয়ে দেয়া হয় উদারতার সাথে। তারা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় হত্যা এবং ধর্ষণ কেন্দ্রগুলি চালিয়ে সচল রাখছেন দেশের উন্নয়নের ভারসাম্য। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগে থেকেই প্রকাশ করে দিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ঘটানো হয়েছে অসামান্য পরিবর্তন। এখন সবাই পরীক্ষায় ৮০% নম্বর পায়। যারা পায় না তাদেরকে দ্বীপান্তর করে দেয়া হয় যোগ্য পুরষ্কার। খাদ্য সমস্যা মেটাতে নিম্নবিত্ত পরিবারদের দেয়া হয়েছে ইচ্ছেমত সাপখোপ-পোকামাকড়, শেয়াল-কুকুর, বৃক্ষ-নদী খাবার স্বাধীনতা। খাদ্যে আমরা এখন স্বয়ংসম্পন্ন। দেশের বৃহত্তম বনে কয়লা জ্বালানী দিয়ে উনুন চালিয়ে রান্না করা হচ্ছে বাঘ, কুমীর, গাছ এবং ফুল। তথাকথিত পরিবেশবাদীরা চক্রান্ত করার চেষ্টা করলে তাদের হত্যা করে খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এসবের কিছুই সম্ভব হতো না যদি আপনাদের সহযোগিতা না পেতাম। আমাদের রাষ্ট্রের মূল নীতি আপনারা আত্মীকরণ করেছেন, এবং তার সফল প্রয়োগ করেছেন। প্রেসিডেন্টকে সর্বজয়ী নেতা হিসেবে গ্রহণ করে তার হাতে সঁপে দিয়েছিলেন যাবতীয় ক্ষমতা। আপনাদের এই বিশ্বাস এবং ভালোবাসার প্রতিদানে কিছু দেয়া আমার কর্তব্য। তাই খুব ভীষণ প্রয়োজন না থাকা স্বত্বেও আমি এলাম আপনাদের কাছে। আজ আমি একটি বিশেষ ঘোষণা দেবো। আপনাদের মত এই মুহূর্তটি আমার জন্যেও বিশেষ স্মরনীয়। আপনারা আনন্দিত অর্জনের প্রত্যাশায়, আমি আনন্দিত প্রদানের গৌরবে।
আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে টয়লেট পেপারের রঙ হবে শুধুমাত্র টিয়ে রঙের। আমাদের এখানে টয়লেট পেপার হয় গোলাপী এবং সাদা, এই দুই রঙের। যা আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে। তাই গোলাপী এবং সাদা রঙয়ের টয়লেট পেপার আজ থেকে নিষিদ্ধ। প্রিয় ভ্রাতা এবং ভগ্নী গণ, যে কোন বিভেদ এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর এই তো সময়!
আজ সারাদিন যে আগ্রহ নিয়ে আপনারা অপেক্ষমান ছিলেন তার যথোপযুক্ত ফলাফল পেয়ে আপনারা নিশ্চয়ই আনন্দিত! আমরা জানি অন্য সব নিয়মের মত এই নিয়মটিও আপনারা মেনে চলবেন, এবং নিয়ম ভঙ্গকারীদের ধরিয়ে দিতে সাহায্য করবেন। আজ থেকে যদি কারো কাছে সাদা বা গোলাপী রঙের টয়লেট পেপার পাওয়া যায়, তাহলে তাকে দেখা মাত্র হত্যা করা হবে, এবং তার লাশ চিড়িয়াখানার সিংহের খাঁচায় নিক্ষেপ করা হবে।
আপনাদের প্রতি অনুরোধ, এখনই বিজয় মিছিল না করে আজ সারাদিনের কর্মকাণ্ডের স্মারক সমস্ত রক্ত, দেহ খণ্ড, পুঁজ এবং মল-মূত্র পরিষ্কার করবেন।
ঝিমঝিমপুর হুঙ্কারবাদ।
(১০)
মানুষ খুশি। শুধু খুশি বললে ভুল হবে, বুনো আনন্দ আর উত্তেজনায় তারা পাগলপারা। প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু তিনি যে এমন চিন্তার অতীত উপহার দেবেন তা কেউ ভাবতে পারে নি। যেহেতু ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই এখন সবাই সবার ভাই। তারা তাজা লাশ, গেলাস গেলাস রক্ত আর পুঁজ, এবং মল-মূত্র ঠেঙিয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করলো। তবে প্রেসিডেন্টের বাণী ভুলে যাবার মত গর্দভ তারা নয়। ফলে সারাদিনে তৈরি হওয়া সমস্ত আবর্জনা পরিষ্কার করতে লাগলো সবাই মিলে। কণ্ঠে তাদের গান, মনে ফূর্তি, কাজ করতে লাগলো নাচের ভঙ্গিতে।
এমন সময় কোথা থেকে যেন এক বিষাদরঙা মেয়ে জোম্বির মত শূন্য দৃষ্টিতে বিস্রস্ত পোষাকে এগিয়ে আসতে লাগলো শহরের প্রধান সড়কের দিকে। এমন উৎসবের দিনে বিশ্ব সংসার সম্পর্কে তার এমন দৈন্য এবং হীন উদাসীনতা সবাইকে ক্রুদ্ধ করলো। তারা এগিয়ে গিয়ে পাপীষ্ঠার পোষাক ছিঁড়ে ফেললো। তার যোনীপথ দিয়ে রক্ত বের হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো সবাইকে। এত রক্ত কোথা থেকে এলো! কী এর উৎস! ও আচ্ছা, মাগীর মাসিক চলছে তাহলে! সে কী রঙের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেছে দেখা দরকার। যদিও আজকের ভাষণে মহামান্য প্রেসিডেন্ট টয়লেট পেপারের ব্যাপারে বলেছেন, তবে বৃহত্তর ঐক্যের জন্যে স্যানিটারি ন্যাপকিনের রঙও এক হওয়া দরকার, কিছু অতি প্রজ্ঞাবান নাগরিক এমন অভিপ্রায়ে মেয়েটার স্যানিটারি ন্যাপকিনের দিকে নজর দিলো।
রক্তে ভেজা বস্তুটির প্রকৃত রঙ এবং নকশা বোঝাটা কষ্টকর। তবে জয় হলো আগ্রহের। তারা আবিষ্কার করলো, স্যানিটারি ন্যাপকিনটায় রক্ত জমে হুবহু প্রেসিডেন্টের মুখের মত আকার ধারণ করেছে । নোংরা ন্যাপকিনটায় তার বিভৎস করে আঁকা চোয়ালটা কেমন যেন অভিমানী শিশুর মত ঠোঁট উল্টিয়ে কান্নার ভঙ্গি করে আছে, যা হাস্য উদ্রেক ঘটালো সবার মাঝে। তবে হাসির প্রাথমিক দমকটা কাটিয়ে তারা একটা নির্জলা আতঙ্কের সম্মুখীন হলো। নোংরা বস্তুটায় প্রেসিডেন্টের কান্না মুখ আঁকলো কোন সে সূত্রধর? এমন তো কখনো দেখে নি, শোনে নি, ভাবে নি! তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো অবিশ্বাস আর বিস্ময় নিয়ে।
তবে কি এটাও সম্ভব...? কিছু ভাবনার বুদবুদ তৈরি হয়ে ভাসতে লাগলো ঝিমঝিমপুরের আকাশে। বদ বাজে পাখি গুলো এসে ঠুকরিয়ে ফুটিয়ে না দেয়!
প্রথম প্রকাশ- http://www.somewhereinblog.net
ইমেজ সূত্র- পিন্টারেস্ট
Comments
Post a Comment