সুইট হোম


এখন....
আগামী সপ্তাহে একটা পার্টির আয়োজন করব ভাবছি। বন্ধুবান্ধব। চেনা মানুষজন। ডিপফ্রিজে ভরে রাখি প্রোটিনের টিন, সবজি, ফল আর ফরমালিন। আয়োজনের ঝক্কিতো কম নয়। আমার সাথে যে পুরুষটা থাকে সে উদাসীন। খুব উদাসীন। আমাকেই যতসব সামলাতে হয়।

রাতে ঘুমোনোর সময়.....

"ডিপফ্রিজে কি আর জায়গা আছে? সে সুধোয়।
"উমম....তিন কেজি মাংস, মাংস.আর..মাংস..আর...উমমম..." আমার মনে পড়েনা আর কি কি আছে।
"আচ্ছা, বাদ দাও, শুতে চল।"
"হ্যাঁ, শোবার সময় হয়ে এল।" আমি সম্মতি জানাই। ঘর গোছগাছে লেগে পড়ি।
"সবকিছু পরিস্কার করেছ তো ঠিকঠাক?"
"খুব ঠিকঠাক, এসোতো.." আমি আমন্ত্রণ জানাই।
আমরা ডিপফ্রিজে ঢুকে পড়ি।

কিছুক্ষণ আগে আমি মাছ, মাংস আর সবজিগুলো ছুঁড়ে ফেলেছি ওখান থেকে। ওরা যথেষ্ঠ সজীবতা পেয়েছে। ওরা যথেষ্ঠ সতেজ হয়ে উঠেছে।

এখন আমাদের সময়। আমাদের রাতের রোমাঞ্চ।
"দেখি তুমি কতটুকু শীতল হলে?" সে আমার গায়ে হাত রেখে উষ্ণতা পরিমাপ করে।

আমি প্রফুল্ল হয়ে উঠি তার রোমান্টিক আচরণে।
"বরফ হতে বাকি শুধু" আমি হাসতে হাসতে বলি।
কোত্থেকে একটা শাবল নিয়ে এসে সে আমাকে খোঁচাতে থাকে। কিন্তু আমি জমে জমে জমে জমে এতই শক্ত হয়ে গেছি, যে বিন্দুমাত্র চিড়ও ধরেনা আমাতে। আমিও শিলনোড়া দিয়ে তার মাথায় বাড়ি দেই। তার বুকে বাড়ি দেই। সেও অনঢ়, প্রস্তর মূর্তির মত ঋজু হয়ে থাকে। আমাদের নিঃশ্বাসে সৃষ্টি হয় তুষারঝড়। আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠি। বিন্দু বিন্দু তুষারকণা জমতে থাকে আমাদের পীঠে, মুখে, সুখে....।

তারপর....

রমণক্লান্ত আমরা। আমাদের প্রয়োজন নিবিড় ঘুম। কিন্তু আমরা জেগে উঠি ঠিক সময়ে। সেই গর্বিত মোরগটার দাম্ভিক নির্দেশে না, অথবা পার্শ্ববর্তী শহরটার, সেই ফেলে আসা শহরটার নিরিবিলি সেই বাসাটার আঙিনায় ঝরে পড়া বকুল ফুলের মাতাল সুবাসে না এই জেগে ওঠা। আমরা জেগে উঠি এমনিতেই। আমাদের জেগে উঠতে হয়।

আমি....

আমি সকালালস্য ঝেড়ে ফেলে সকালালসার পাটি পেতে বসি। আমি লাখে লাখে অজানা অদৃশ্য মূল্যবান বস্তু আমার পেটিকোটের ভেতরে, শাড়ীর আঁচলে গুঁজে রাখি। এইসব অদৃশ্য বস্তু আমায় বস্তুবাদী জীবনে চলার সনদ প্রদান করে। আমি আগুন এড়িয়ে চলার বন্দোবস্ত করি, আমিই আগুন তৈরী করি।
আমাকে সে তাগাদা দেয় সকালের নাস্তার জন্যে। আমি এলোমেলো হয়ে থাকা ঘরের দিকে তাকাই। মাংসগুলোতে কি পচন ধরল নাকি? কালরাতে ডিপফ্রিজ থেকে ছুড়ে ফেলা সেই মাংসগুলো। কেমন যেন গন্ধ বেড়ুচ্ছে। সে যাকগে, এগুলোতো আমাদের আগামী সপ্তার পার্টির জন্যে। এখনকার কথা ভাবি বরং। ফাঙ্গাস পড়া কয়েকটুকরো পাউরুটি আর হাইড্রোজেন সালফাইডের গন্ধযুক্ত একটা ডিম ছুড়ে দিই কড়াইটায়। আগুন আর তেলের সাথে লড়াই দেখতে ভালো লাগে। আমি উত্তপ্ত কড়াইটা হাতে নিয়ে তার গালের সাথে চেপে ধরি।
"সারপ্রাইজ!" ওকে চমকে দিতে চাই আমি। আমার অনুমিত আচরণই করে সে। হঠাৎ উত্তাপ পেয়ে ভীষণ চমকে ওঠে। বিস্মিত হয় খুব। আমি কড়াইটার হাতল চেপে ধরেই রাখি। একটু উষ্ণতার জন্যে। যথেষ্ঠ উষ্ণতা সঞ্চালিত হবার পরে আমাদের আড়মোড়া ভেঙে যায়। আমাদের ক্ষিধে পায়। আমরা ফাঙ্গাস পড়া পাউরুটি আর খোসাসুদ্ধ ডিমের অমলেট কচকচিয়ে খাই। আমরা পরিতৃপ্ত হই। ব্যস্ত হয়ে সে যখন চলে যাচ্ছিলো, আমি তাকে দরোজা থেকে ফেরাই,
"এই শোনো!"
"কি?"
"আর কিছু খাবেনা?"
"আর কি?"
"এই যেমন ধর....একটা চুমু?"
"ধুর! বিবমিষা জাগে"
"আচ্ছা, ঠিক আছে, দুপুরে অন্য কোথাও খেয়ে নিও বেশ্যার কাস্টমার"
আমি তার স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতনতা দেখাই।
"ঠিক আছে ডার্টি টু টাইমার, তুমিও অনিয়ম করোনা যেন!"
সহ অনুভূতি তার কন্ঠেও।

একা....

সে চলে যবার পরে আমি আমাদের আগামী সপ্তার পার্টিটা নিয়ে ভাবতে বসি। আমাদের ডিপফ্রিজে আছে উদরপূর্তির অনেক উপকরণ। মাংসগুলোতে একটু গন্ধ, মাছগুলোতেও, তরতাজা সবজিগুলো খটখটে হয়ে গেছে। আগামী সপ্তার মধ্যে হয়তো এগুলো সব পচে যাবে, গলে যাবে, তাতে কি! অদৃশ্যতো হয়ে যাবেনা! আর হলেই বা কি! আমি অদৃশ্যে বিশ্বাস করি। অনুভূতিগুলো অদৃশ্য, কামনাগুলো অদৃশ্য, প্রতি প্রহরে প্রশংসা পাবার আশায় চেয়ে থাকে যে কল্পিত ভীমমুখ, সেও অদৃশ্য। আমি সেই অদৃশ্য চোখমুখ আর হূমকি-ধামকি ভয় পাই। নির্জন দুপুরে আমার চোরা চোখ যে ব্যালকনিটায় চলে যায়, সেখানে মিশে থাকে পাপ, ভাতঘুমপূর্ব সময়টায় আমার পূর্ব প্রেমিকের হঠাৎ আগমনে আগুন জেগে ওঠে, সে আগুনের আভায় আমি রক্তিম হয়ে উঠি, সুন্দর হয়ে উঠি, কিন্তু পরক্ষণেই আমাতে জেঁকে বসে অন্য আগুনে, অন্যসময়ে অঙ্গার হবার ভয়....পাপ।
তাই আমি ক্লান্তাঙ্গুলে মাস্তুল ধরে থাকি, আর জাদুর পাটিতে করে চলে যাই কিছু মূল্যবান অদৃশ্য বস্তু কিনে নিতে।

সে দিনটা....

দেখতে দেখতে সপ্তাহের সে দিনটা চলে আসে। আমরা ঘরকে সুসজ্জিত করতে মনোনিবেশ করি। আমার সে! বরাবরই অলস। কিন্তু এবার তাকে বিশেষরকম তৎপর দেখা যায়। প্রতিরাতে ঘুমোনার সময় ডিপফ্রিজ থেকে দূরে ছুড়ে ফেলা বস্তগুলোর দিকে সে সোৎসাহে তাকায়। ওগুলো পচে গন্ধ ছড়াচ্ছে, বেড়ালে এসে অর্ধেকটা খেয়ে গিয়েছে। পুরোটা খেতে পারেনি হয়তবা গন্ধটা বেশি উৎকট হবার কারণে। সে এক আশ্চর্য উপায় বের করে ফেলে ওগুলোকে পরিবেশনের যোগ্য করতে। ওগুলোতে সসের বদলে আমার লিপস্টিক গুলো ঘষতে থাকে, আর তেল নুনের বদলে পারফিউমের শিশি উপুর করে দেয়।
"এগুলোর কোনই দরকার ছিলোনা, ওরা এমনিতেই খেতো" আমি বলি।
"আরে কি যে বল! পরিবেশনযোগ্য করাটাই বেশি জরুরী, স্বাদ যেরকম হোক না কেন!"
আমি ওর কথা মেনে নেই। আমরা সুসজ্জিত করতে থাকি আমাদের ঘর। আমাদের পুরোনো অন্তর্বাস, ব্যবহৃত টিস্যু পেপার, আর নিরোধকসামগ্রীগুলো এঁটে দেই দেয়ালে। অতঃপর সবকিছু ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন করার পরে আমরা টেলিভিশনে দেখতে বসি। আমরা পরিবেশনার নিয়ম শিখি।

ঝড়...

হঠাৎ এক ঝরে উড়ে চলে আসে বড় রাস্তার সামনে স্থাপিত ঢাউস বিলবোর্ডের একাংশ। আমরা ওটাকেও মূল্যবান একটা স্যুভেনির হিসেব গণ্য করে লটকে দিই ঘরের এক কোনায়। সেই সাথে একটু চিন্তিতও হয়ে উঠি, হঠাৎ এমন ঝড়ে, এমনতর বিরূপ আবহাওয়ায় অতিথিরা সব আসবেতো! ওদের জন্যে কত আয়োজন করে রেখেছি! ঝড় বাড়তে থাকে। কেউ আসেনা। আমরা সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আমাদের নিদ্রালু চোখ অপেক্ষায় থাকতে অপারগ....

পার্টি!

"সারপ্রাইজ!"
হঠাৎ কার কন্ঠে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। খুব ঝড় হচ্ছে এখনও। ঝড়ের প্রলয়ে ঘরের দরোজা খুলে গেছে। হুহু করে বাতাস ঢুকছে। আর সেইসাথে পঙ্গপালের মত অতিথিরা।
"সারপ্রাইজ!"
আমার প্রাক্তন প্রেমিক।
"সারপ্রাইজ!"
পাশের বাসার সেই ছেলেটা, যে অলস দুপুরে ব্যালকনিতে বসে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
"সারপ্রাইজ!"
ফোনের অপরপ্রান্তের সেই অদেখা যুবক।
"সারপ্রাইজ!"
কোত্থেকে যেন চলে আসে আমার দূর সম্পর্কের এক চাচা বা মামা গোছের কেউ, ছোটবেলায় যে গভীর আগ্রহের সাঠে আমার পীঠে হাত রেখে জ্ঞানের কথা বলতে চাইতো।
ঝড়ো হাওয়ায় লন্ডভন্ড হতে থাকে আমাদের ঘর। কিন্তু অতিথিরা আসতেই থাকে, আসতেই থাকে। আমার সাথে যে বসবাস কর, তার কাছেও অনেক সারপ্রাইজ আসছে দেখছি!
আমরা আনন্দিত হই। যে যার অতিথি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ডিনার টেবিল পচা মাংসের গন্ধে সুরভিত হয়ে ওঠে। সবাই গোগ্রাসে গিলতে থাকে মাংস। কাঠ হয়ে যাওয়া শক্ত ভেজিটেবল শুস্কচোখে তাকিয়ে থাকে। ওদিকে নজর নেই কারও। আমরা সবাই মাংস খাই, মাংস বয়ে বেড়াই।
ঝড়ে লন্ডভন্ড হয় আমাদের ঘর। আমাদের সজ্জিত সামগ্রীগুলো উড়ে উড়ে একেকজনের কাছে চলে যায়।
পুরোনো অন্তর্বাস আর নিরোধক।
কেউ কোনটার গন্ধ নেয়, কেউ কোনটা পরিধান করে।
এতগুলো মানুষ! উষ্ণ হয়ে ওঠে ঘর তাদের নিঃশ্বাসে। চমৎকার উৎসব শুরু হয়। উপভোগ্য হয়ে ওঠে সময়। ভোগ্য হয়ে ওঠে সময়।

ডিপফ্রিজ....

আমরা নতুন একটা ডিপফ্রিজ কিনেছি। এটা আগেরটার চেয়েও বড়। আমাদের ঘুম ভাল হয় এখন। মাঝরাতে, শেষরাতে ...বা যখন তখন ঘুম ভেঙে গেলে জমে থাকা তুষারকণাগুলো সরিয়ে দিতে দিতে আমরা আরেকটা উৎসবের পরিকল্পনা করতে থাকি...

(এটা ভালো লাগলে ভালো লাগবে   জবাইঘর  )
  

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মুভি রিভিউ 'মাদার' এ্যারোনোফস্কির মেইনস্ট্রিম ওয়ান্ডার!

ইলুমিনাতি, একটি মার্কেটিং টুল; অথবা ছহি ইলুমিনাতি শিক্ষা