মুভি রিভিউ- The Vanishing (1988) যে মুভিটি আমাকে তাড়া করে বেড়ায় এখনও!


এই ডাচ মুভিটি যখন দেখি, তার  প্রায় সাত মাস আগের সময়টায় কোনো  সিনেমা দেখিনি বিভিন্ন কারণে। অপেক্ষা করছিলাম দারুণ কিছু দিয়ে শুরু করার। আকাঙ্ক্ষার ফলাফল যদি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক গুণ বেশি হয়, তাহলে এক ধরনের বিহবল অবস্থা সৃষ্টি হয়। The vanishing দেখার পর সেই অপূর্ব বিহবলতায় সময় অতিক্রান্ত হয়েছিলো। 
প্রথমেই একটি সতর্কতা দিয়ে রাখি। যারা নরম হৃদয়ের অধিকারী, এবং সহজেই ডিস্টার্বড হন, তারা এই সিনেমাটি ভুলেও দেখবেন না। এ কথা শুনে নিশ্চয়ই ভাবছেন যে সিনেমাটি সেক্স, ভায়োলেন্স এবং প্রোফেইনিটি দিয়ে ভরা! যেমনটা দেখেছেন Cannibal Holocaust অথবা I spit on your grave এ! ভুল, পুরোপুরি ভুল! সিনেমাটিতে অতি সামান্য পরিমাণে ভায়োলেন্স আছে। একজন লোক আরেকজনকে মাটিতে শুইয়ে কিছুক্ষণ ঘুষি-লাথি মারলো, খুবই দুর্বল মার, কোনো রক্তারক্তি হলো না। এই দৃশ্য তো একটা শিশুও দেখতে পারে, না কি বলেন? পুরো মুভিতে শিট শব্দটি মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো এফ ওয়ার্ড নেই। যৌনতা- একেবারেই নেই। ড্রাগস- নেই। আপনি যদি টেনে টেনে দেখেন, মনে হতে পারে যে আপনাকে ব্লাফ দিয়ে সময় নষ্ট করার কুবুদ্ধি এঁটেছি। তাই আগে থেকেই বলে রাখি, সিনেমাটি কিছুটা স্লো। এটি আপনার পূর্ণ মনোযোগ দাবী করে। এর ডিটেইলস যত ভালোভাবে অবজার্ভ করবেন ততই এর শক ভ্যালু বাড়বে, এবং আপনাকে পেয়ে বসবে। পপকর্ণ নিয়ে দেখতে শুরু করে দেখা শেষে আপনার প্রয়োজন হতে পারে ঠান্ডা এক বোতল লেবুর শরবত স্নায়ু শীতল করার জন্যে। তাহলে রেডি তো? চলুন শুরু করা যাক। 
সিনেমার শুরু একটি সিম্বলিক দৃশ্য দিয়ে। ক্লোজ-আপে একটি গাছ, তার পত্র-পল্লব। কিন্তু ক্যামেরাটি জুম আউট করার পর বোঝা যায় যাকে আপনি ডাল ভেবেছিলেন, সেটি আসলে একটি পোকা! এই যে আপনি-আমি সুন্দর জামা কাপড় পরে বউ-বাচ্চা-বান্ধবী নিয়ে বেড়াতে যাই, স্মার্টফোনে অনলাইন পেপারে খেলা এবং বিনোদনের খবর পড়ি, প্রিয়জনের কাছ থেকে জন্মদিনে উপহার পেয়ে আনন্দিত হই, আমাদের এই সুশোভিত বৃক্ষরূপের ভেতরে কি বিষাক্ত কীট লুকিয়ে নেই? আছে। কারো কম, কারো বেশি। এখানে আমরা তেমন এক মানুষের গল্প জানবো। নাম তার Raymonds. একজন মাঝবয়েসী ফরাসী ভদ্রলোক। দুই মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে তার সুখের সংসার। বাচ্চারা তাকে ভালোবাসে, স্ত্রীর বিশ্বাস কখনও ভাঙেন নি তিনি। তবে তার আগে পরিচিত হতে হবে রেক্স এবং সাসকিয়ার সাথে।
রেক্স এবং সাসকিয়া দারুণ জুটি! একদম পারফেক্ট প্রেমিক-প্রেমিকা। থাকে নেদারল্যান্ডে। গাড়ি করে এক লম্বা ট্রিপে ঘুরতে বের হয় তারা। সাসকিয়া এক দারুণ প্রাণবন্ত আর সুন্দর তরুণী। রেক্স তো তার জন্যে জীবন উৎসর্গ করবেই! যাত্রা বিরতিতে সাসকিয়া একটি সুপার শপে যায় কোক আর বিয়ার কিনতে। তখন কি আর তারা জানতো যে এটাই তাদের শেষ দেখা?
হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আশেপাশে ঘুরে গাড়িতে আসার পর রেক্স দেখে যে সাসকিয়া তখনও আসেনি। একে ওকে জিজ্ঞাসা করে কোনো হদিশ পেলো না। কোথায় গেলো সে? কী হলো তার? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে সে ৩ বছর ধরে। এই ৩ বছরে সে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে হ্যান্ডবিল ছাপিয়েছে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে, টিভিতে অনুনয় করেছে, সাসকিয়াকে ছিনিয়ে নিয়েছে, সে একবার একটু তার কাছে আসুক, বলুক কেন এই কাজ সে করেছে, তার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না জীবনে।
ভালোবাসা হলে তো এমনই হওয়া উচিত, তাই না? রেক্সের এই আত্মনিবেদন আর প্যাশনের কারণেই সিনেমাটি এত ভয়ংকর রকম ট্রাজিক আর শকিং হয়েছে। আবারও বলছি, আপনি যদি সহজেই ডিপ্রেসড হন, তাহলে এখানেই থেমে যান, সিনেমাটি দেখার কথা ভুলেও ভাববেন না।
ভিলেনের নাম তো আগেই বলেছি, রেমন্ডস। আগেই বলে দিয়েছি বলে ভাববেন না যে স্পয়লার হয়ে গেছে। এটা ঠিক টুইস্ট নির্ভর মুভি না। রেমন্ডস একজন সোশিওপ্যাথ, ক্লাস্ট্রোফোবিক মানুষ। তার সমস্যার শুরু ছেলেবেলায়। একদিন বারান্দার রেলিংয়ে ভর দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে তার অদ্ভুত এক চিন্তা মাথায় এলো। মানুষের জীবন কি নিয়তি নির্ধারিত? যদি তাই হয়, তাহলে তো বড় ভয়ংকর ব্যাপার! নিয়তির কাছে বাঁধা পড়ে থাকবে সে? এতই সীমাবদ্ধ মানুষের জীবন? সে এই অতি ক্ষুদ্র গণ্ডিকে অস্বীকার করতে চাইলো, নিয়তিকে অগ্রাহ্য করতে চাইলো। অসহ্য রকম ছটফটিয়ে সে মুক্তির উপায় খুঁজলো, চ্যালেঞ্জ করলো নিয়তিকে। কীভাবে মিলবে পরিত্রাণ, কীভাবে! হঠাৎ তার মাথায় সমাধান চলে এলো। সে কেন লাফ দিচ্ছে না! লাফ দিলেই তো সে ভাংতে পারে নিয়তির সংবিধান! এবং সে তাই করলো। কিন্তু নিয়তি কি এমন সহজ চিজ! হাত ভেঙে যাওয়া, আর দুটি আঙুল হারানো ছাড়া তার কোনো ক্ষতিই হলো না। কিন্তু তার ভেতরে জন্ম নিলো এক ভয়ংকর পিশাচ।
না, রেমন্ড অন্যান্য সাইকোদের মত কিশোরবেলা থেকে নিষ্ঠার সাথে কুকুর-বেড়ালকে খুঁচিয়ে মেরে, অথবা বাচ্চাদের দম বন্ধ করে আনন্দ পেতো না মোটেও। বরং ভায়োলেন্স তার অপছন্দ ছিলো। সে কাজ করতো অবসেশন নিয়ে, প্যাশন নিয়ে। রেক্সের মধ্যে সে ঠিক সেই জিনিসটাই খুঁজে পেয়েছিলো। সারাজীবন ধরে সে এটাই খুঁজে ফিরেছে। একটা পারফেক্ট ক্রাইম, একটা ভীষণ ইমপ্যাক্ট, যার কোনো তুলনা হয় না। তবে এতে করে কিন্তু তার স্বাভাবিক জীবনাচরণে কোনো সমস্যা হয় নি। বিয়ে করেছে, বেছে নিয়েছে ভালো একটি কাজ, দায়িত্বশীল পিতা হিসেবে তার প্রশংসা সবার মুখে মুখে। কিন্তু ছোটবেলায় যার মধ্যে প্রোথিত হয়েছে ভয়ানক ব্যাধি, তা থেকে নিস্কৃতি সে কোনোভাবেই পেতে চায় নি। সুযোগ খুঁজছিলো, একদিন মিলেও গেলো।
পরিবারের সাথে অবকাশযাপনের সময় একদিন এক ঘটনা ঘটলো। পাশেই লেকে একটা বাচ্চা মেয়ে পড়ে গেলো। মেয়েটি মারা যাচ্ছিলো। তখন সে ঝাঁপ দিয়ে তাকে রক্ষা করলো। তার বাচ্চাদের কাছে সে তখন হিরো। এমন অনুভূতি নিঃসন্দেহে যে কারো জীবনকে মহিমান্বিত করবে। কিন্তু রেমন্ডের ক্ষেত্রে হলো তার ঠিক উল্টো। তার কাছে মনে হলো, তার সন্তানরা যা ভাবছে তাকে তার থেকেও বড় হতে হবে। হিরোইজম দেখিয়ে হাততালি পাওয়া তার জীবনের লক্ষ্য নয়। এতে করে সে তৃপ্ত নয়। তার ব্যাপ্তিটা আরো বড়, আরো ব্যাপক। মানুষের জীবন রক্ষা করার মধ্যে যে অভিঘাত তৈরি হয়, তা খুবই ঠুনকো। কাউকে কারো জীবন থেকে কেড়ে নিতে পারলে বরং এর চেয়ে বেশি ইমপ্যাক্ট তৈরি হতে পারে। শুরু হলো সেই পুরোনো লড়াই নতুন করে। নিয়তির ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সে লড়ে সস্তা হিরো থেকে হয়ে উঠবে এক মহান শয়তান!
এতক্ষণে নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না যে সেদিন সাসকিয়াকেকে অপহরণ করেছিলো? হ্যাঁ, রেমন্ড। শুধু অপহরণ করে ক্ষান্ত থাকেনি। পরবর্তী তিন বছর গভীর নিষ্ঠার সাথে পর্ববেক্ষণ করেছে রেক্সের জীবন, মন। যখন সে বুঝতে পেরেছে যে রেক্সের জীবনের লক্ষ্য শুধুমাত্র সাসকিয়ার অন্তর্ধান রহস্য আবিষ্কার করা ছাড়া আর কিছুই নয়, তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় তার মুখোমুখি হবার, তাকে জানিয়ে দেবার, আসলে কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে।
মুভিটি কেন এত হরিফায়িং? কারণ এর শীতল চরিত্র, রেমন্ডের অতি স্বাভাবিক জীবনযাপন, আর রেক্সের ভয়ানক প্যাশন। সবকিছু মিলে আমরা শেষে মুখোমুখি হবো এমন এক সমাপ্তির, যা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়াতে পারে বছরের পর বছর। একদিন সময় নিয়ে এক ফ্লাস্ক কফিসহ দেখতে বসুন, সময়টা বৃথা যাবে না।
শেষে আরো একটি সতর্কতা জানিয়ে দেই, এই সিনেমার একই নামের একটি আমেরিকান ভার্শন আছে ১৯৯৩ সালের। ভুলেও সেটা দেখবেন না। আমি যেটার কথা বললাম, সেটি ডাচ মুভি, ১৯৮৮ সালের। আর এর অরিজিনাল টাইটেল হলো- “Spoorloos”।


Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মুভি রিভিউ 'মাদার' এ্যারোনোফস্কির মেইনস্ট্রিম ওয়ান্ডার!

ইলুমিনাতি, একটি মার্কেটিং টুল; অথবা ছহি ইলুমিনাতি শিক্ষা