বিষণ্ণ সন্ধ্যার প্লে লিস্ট, আইয়ূব বাচ্চুর ক্রিমিনালি আন্ডাররেটেড ১০টি গান


প্রিয় বাচ্চু ভাই,

আপনি নেই দুইদিন হলো। এই মুহূর্তে যখন আপনাকে লেখাটি লিখতে বসেছি, তখন আপনার জানাজা হচ্ছে। কত মানুষ আপনাকে সম্মান জানাতে গেছে! এখনও কি খুব একা লাগছে? এখনও কি অবাক হৃদয় নিয়ে শুধু কেঁদে কেঁদে যাবেন নীরবে? আপনি কাঁদবেন কেন? আপনি তো যেভাবে চেয়েছিলেন, সেভাবেই জীবনটা কাটিয়ে গেলেন! আপনি চেয়েছিলেন শুধুমাত্র গান নিয়ে থাকতে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গান করে যেতে। তাই তো করলেন! চলে যাবার আগের দিনও কনসার্ট করেছেন। হার্টের ৩০% সক্ষমতা নিয়ে এত  পাগলামী না করলে চলতো না? চলে যাবার কি এতই তাড়া ছিলো? আপনি না জয়া আহসান আর শবনম ফারিয়াকে কথা  দিয়েছিলেন, ‘দেবী’ অবশ্যই দেখবেন! তার আগেরদিনই চলে যেতে হলো?  আপনার চলে যাওয়াতে অপরিসীম শূন্যতা অনুভব করেছি, তারপরেও কিন্তু পরেরদিন ঠিকই দেবী দেখতে গিয়েছি।  সামনাসামনি জয়া আহসান আর শবনম ফারিয়াকে দেখে আনন্দিত হয়েছি, এসে বিশাল রিভিউও লিখেছি। বাচ্চু ভাই, Show must go on! জেমস ভাই এ কথাই বলেছিলেন আপনার চলে যাবার দিন কনসার্টে গাইতে গিয়ে অবাধ্য কান্নাকে প্রশ্রয় দিয়ে। আপনাকে নিয়ে আগে যে লেখাটা লিখেছিলাম, সেটা অনেক মানুষের কাছে পৌঁছেছে। সোশাল মিডিয়ায় যেমন হয়, কেউ একজন মারা গেলে তার খুব কাটতি হয়, তারপর আবার অন্য ইস্যুতে ব্যস্ত হয়ে যায় সবাই, আপনার ক্ষেত্রে এরকম কিছু অন্তত আমার তরফ থেকে হবে না। তাই এই চিঠিটা লিখতে বসা। আপনার কিছু ক্রিমিনালি আন্ডাররেটেড গান সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাবো আজ। আহা, এই সেদিন আমি ছিলাম মুখচোরা কিশোর, যার গার্ডিয়ান এ্যাঞ্জেল ছিলেন আপনি, আর আজকে আমি নতুন প্রজন্মকে আপনার হারিয়ে যাওয়া গান নিয়ে দীক্ষা দিচ্ছি! আসলে তো দিন এমনি করেই হারিয়ে যাবে!
এই দেখেন, লিখতে লিখতে আপনার গানের লাইন চলে আসলো। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের যতরকম অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব, তার সবই আপনি গানে বেঁধেছেন। এই গানটি নিয়েই শুরু করি, কী বলেন!
১। সময়ের স্রোতে
 ঘুমন্ত শহর এ্যালবামের বি পিঠের তিন নম্বর গান। ঘুমন্ত শহর এ্যালবামটা কিনেছিলাম পাবনা থেকে। আমার বন্ধু দ্বীপের সাথে। এ্যালবাম কেনার পর আমাদের সে কী উত্তেজনা! এর আগে গীতিবিচিত্রায় “ঘুমন্ত শহরে” গানটি শুনে শিহরিত হয়েছিলাম। ঘুমন্ত শহর পুরো এ্যালবামটাই ক্রিমিনালি আন্ডাররেটেড, তাই না? আপনি নিজেও তো এই এ্যালবামের ঘুমন্ত শহরে ছাড়া অন্য কোনো গান কনসার্টে করতেন না। সময়ের স্রোতে গানটি প্রথমবার শুনে অতটা ভালো লাগে নি। কিছুদিন পর ঈদের ব্যান্ড শো দেখতে বসেছি, আর ভাবছি এল আর বি কী গান গাইবে! আমার সকল অনুমান ভুল প্রমাণ করে এল আর বি এই গানটিই করলো! আর আমি অবাক হয়ে অনুভব করলাম, এর আশ্চর্য সুন্দর মেলোডি! পারফরমেন্সটা খুব লাইভলি ছিলো। আমার টুটুল ভাইয়ের কি-বোর্ড প্লেইংয়ের কথা মনে পড়ছে। তার শরীরের ভেতর দিয়ে যেন সুর প্রবাহিত হচ্ছিলো, এত প্রাণোচ্ছল! খুব আনন্দ নিয়ে করেছিলেন গানটা। আমারও আনন্দ লেগেছিলো। যদিও গানের কথাগুলি দুঃখের।
চিনবে না কেউ জানবে না কেউ কোথায় কবে
ছিলে তুমি ছিলেম আমি সকাল-দুপুর সন্ধ্যা-সাঁঝে।
আসলে তো দিন এমনি ভাবেই হারিয়ে যাবে।।
ঘাসের সঙ্গে ফড়িং গুলো খেলবে ঠিকই
নাচবে যেন এলোমেলো সেই ছোট্ট পাখি
শ্যাওলা গুলো একটু কালো হতেও পারে
বেঞ্চটা থাকবে অনড় ঐ লেকের ধারে ।
হয়ত বা দিন এমনি করেই হারিয়ে যাবে
বুঝবো না কেউ, খুঁজবো না কেউ কোথায় কবে...
ছিলে তুমি, ছিলেম আম্‌ সকাল-দুপুর, সন্ধ্যা-সাঁঝে
আসলে তো দিন এমনি করেই হারিয়ে যাবে ।
চেনা পথে কৃষ্ণচূড়ার লাল থাকবে একই সাথে
ধ্রুব তারা আকাশ কোণে দেবে উকি
চায়ের প্রিয় স্টলে হয়ত জ্বলবে গ্যাসের শিখা আজও
কপালে বাড়বে বয়সের বলিরেখা”
অসাধারণ এই লিরিকটি লিখেছেন যায়েদ আমিন। এত সুন্দর লিখতেন, হতে পারতেন লিরিকের রাজা, কেন যে হারিয়ে গেলেন! শুনলাম ভালো চাকুরি করছেন এখন।

২। আমার আর কিছু নেই
 ঘুমন্ত শহর এ্যালবামের এ পিঠের শেষ গান। এই গানটিও প্রথমবার শুনে অত ভালো লাগে নি। আসলে যে বয়সে শুনেছি, তখন এই গান নেয়ার মত ম্যাচুইরিটি ছিলো না হয়তো। বুকের মধ্যে হাহাকার জাগানো এক গান। এখন বুঝি। শিরোনামের কথাটা আমি অনেক জায়গায় অনেক সময় ব্যবহার করেছি। এভাবেই তো আপনি মিশে যান হৃদয়ের গভীন গোপনে!
“আমার রূপকথা নেই
আমার শুকসারি নেই
ঝাড়বাতি জ্বালানো
সাজানো সাজঘর নেই
শুধু একটা গিটার
আর একটা তুমি ছাড়া
আমার আর কিছু নেই

তোমাকে ভেবে ভেবে
আমার হাতের গিটার
কেঁদেছে কত রাত
একাকী কত দুপুরে!
কেটেছে কত দিন

পৃথিবীর অলিগলি
দেয়ালে আছে লেখা
আমার অনেক কথা
জেনে নিও তুমি গোপনে
পাহাড়ের কাছ থেকে
নীরবে চোখ চেয়ে চেয়ে”
এই অসাধারণ গীতিকাব্য কার লেখা আমার মনে পড়ছে না। আপনার কণ্ঠের গভীর বিষাদটুকু সম্বল করেই মন খারাপের প্রহরে গুণগুণ করি।
৩। এখন অনেক রাত
 লিস্টে এই নামটা দেখে সবাই নিশ্চয়ই রে রে করে তেড়ে আসবে! আপনার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে একটিকে আমি আন্ডাররেটেড লিস্টে রাখছি! অনেকেই হয়তো আমার মাথার সুস্থতা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে গেছে! আপনি এসব দেখে হাসছেন নিশ্চয়ই! আচ্ছা ওদেরকে ব্যাপারটা খুলেই বলি, কেমন?
 এই যে শ্রোতাবৃন্দ,  এখন অনেক রাত গানটির যে ভার্শন আপনারা শোনেন সেটা ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম আনপ্লাগড এ্যালবাম এল আর বির “ফেরারী মন” এর। ঐ এ্যালবামের সবগুলো গানই পুরোনো। এখন অনেক রাত প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে টুগেদার নামক মিক্সড এ্যালবামে। সেই এ্যালবামে কেউ কিন্তু ব্যান্ড হিসেবে পারফর্ম করে নি! সবার পরিচয় ছিলো-গিটারিস্ট। বাচ্চু ভাই ছাড়াও ছিলেন লাবু রহমান, নীলয় দা, রেশাদ, জেমস এবং পার্থ বড়ুয়া। অসাধারণ সব গান ছিলো এ্যালবামটিতে, কিন্তু সেভাবে নাম ছড়ায় নি। এখন অনেক রাত গানটির মূল ভার্শন অনেক বেশি এ্যাগ্রেসিভ! গিটার সলো এবং রিফগুলি গায়ে কাঁটা তোলার মত, একটা সাসপেন্সের আবহ সৃষ্টি করে। ফেরারী মন এর এখন অনেক রাত সুনীল দার বেহালার কল্যাণে অর্জন করেছে মেলানকোলিক ম্যাগনিফিকেন্স, আর মূল গানটি থেকে অনেকটাই ভিন্ন চরিত্র ধারণ করেছে। এজন্যে আমার কাছে দুটো গানকে অনেকটাই আলাদা মনে হয়।
৪। বদলে গিয়েছে সময়
 ঘুমন্ত শহর এ্যালবাম প্রকাশের কিছুদিন আগে আপনি একটি ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। আপনি মানে পুরো এল আরবিই আর কী। সেখানে শুনেছিলাম “চলো বদলে যাই” এর দ্বিতীয় পর্ব আসছে! সে কী কথা! যে গানটি আমার কাছে আরাধনার মত, তার দ্বিতীয় পর্ব! সেটাও নিশ্চয়ই অপার্থিব কিছু হবে! কিন্ত ঘুমন্ত শহর এ্যালবামে চলো বদলে যাই এর দ্বিতীয় পর্ব নামে কোনো গান দেখলাম না। তাহলে ব্যাপারটা কী! ব্যাপারটা বোঝা গেলো এ পিঠের পাঁচ নম্বর গানে!
“সেই তোমাকে ফিরে পেয়েছি
আমাকেও ক্ষমা করেছো তুমি
এতগুলো দিন কী করে ছিলে তুমি
তোমাকে ভেবে ভেবে কেঁদেছি আমি
কষ্টে ভেঙ্গে যাওয়া আমাদের দুটি মন
কখন যে কোন ঝড়ো হাওয়ায় হয়েছিল দুটি রঙ
তবুও শান্ত থেকেছি বুকে টেনে নিয়েছি
ভুলে যেতে সব অতীতের দিন
আবার সেই তুমি সেই আমি ।
বদলে গিয়েছ তুমি বদলে গিয়েছি আমি
বদলে গিয়েছে সময়”
বদলে দিলেন সময়টাকে! প্রথমবার গানটা শুনেই আমি মোহিত। যতবার শুনি ঘোর শুধু বেড়েই চলে। সেই অপার্থিব অনুভূতিটাই পেয়েছিলাম, যা আশা করেছিলাম। তবে এ গানটি তেমন একটা প্রচার না পাওয়ার একটা কারণ হয়তো এটার সুরের কমপ্লেক্স মেকানিজম। গাওয়াটাও বেশ কঠিন। আমার কিন্তু সেই তখন থেকেই মুখস্থ! আপনার সব গানই তো একসময় মুখস্থ ছিলো, নতুন করে আর কী বলবো!
৫। তখনও জানতে বাকি
 বাচ্চু ভাই, বোনানজা নামক এক অসাধারণ গান প্রকাশনা থেকে যখন ‘ঝড়’ মিক্সড এ্যালবামটি বের হলো, যোগাড় করতে যে কী কষ্ট হয়েছে! মফস্বল শহর সৈয়দপুরে এ্যালবাম আসতো দেরিতে। আর এমন আনকোরা প্রকাশনা সংস্থার এ্যালবাম পাওয়া তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মত ব্যাপার! আব্বুর সাথে বাজারে গেলে ভয়ে ভয়ে শহরের সবচেয়ে বড় গানের দোকানটির সামনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতাম (নাম সম্ভবত ছিলো এলিট ), উনার মন ভালো থাকলে সর্বোচ্চ একটি এ্যালবাম কিনে দিতেন। তখন আমাকে পকেটখরচ দেয়া হতো না। ঝড় এ্যালবামটি যোগাড় করতে তাই অনেক ঝড়ঝঞ্জা পেরুতে হয়েছে। তাও কিনতে পারি নি। শুনলাম কলোনির বন্ধু শিবলীর কাছে আছে এ্যালবামটি। তার কাছ থেকে রেকর্ড করে নিলাম। বোনানজা সম্পর্কে কিছু না বললে অন্যায় হবে। আমি জানি না এটি কাদের কোম্পানি ছিলো, তবে ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা ছিলো তাদের মধ্যে। তারা সেই সময়ে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড সিনারিও তৈরি করতে চেয়েছিলো। হাবিব-বালামের ব্যান্ড রেনিগেইডসের প্রথম এ্যালবাম বেরিয়েছিলো বোনানজা থেকে, অর্থহীনের সুমনের প্রথম গানও সম্ভবত ঝড় এ্যালবামেই ছিলো। মাইলসের ইকবাল আসিফের ব্যান্ড লিজেন্ডের একমাত্র এ্যালবামটিও বোনানজা থেকে প্রকাশিত। যাই হোক...
তখনও জানতে বাকি একটি আশ্চর্য কোমল গান। আমি জানি, আপনি গানে আপনাকে নানাভাবে প্রকাশিত করেছেন। আপনার ভালোবাসার মানুষটির কাছে আপনি কতটা নিবেদিত ছিলেন অনুভব করি।
“তখনও জানতে বাকি
তুমি আর আমি
কার চেয়ে কে বেশি
কাকে ভালোবাসি
এখন আর তখনে
জীবনসীমায়
তোমার ছলনাগুলো এখনও কাঁদায়”
হয়তো বা কিছুটা বাস্তব, কিছুটা কল্পনা। তবে এমন গভীর সুর একদম শূন্যক্ষেত থেকে আসতে পারে না, আমার বিশ্বাস।
৬। নষ্ট করেছে আমাদের
 তবুও এ্যালবামের এ পিঠের দুই নম্বর গান।  তবুও এ্যালবামটির সব গানের কথাই বলতে হয়। এটা যে কী ছিলো, মানুষ দুই যুগেও বোঝে নি। এখন হয়তো বুঝবে, আপনি চলে যাবার পর। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ থেকে এমন কিছু বের হয়েছিলো এটা বিশ্বাস করাও কঠিন! গীতিকার যায়েদ আমিন, যাকে বলে একদম কাঁপিয়ে দিয়েছে! এটাতে সুর না বসালেও গান হয়ে যেত, এমনই শক্তিশালী ছন্দের লিরিক!
“  এই ঘর এই বাড়ি এই পরিবার
এই হাসি কান্না এই চিৎকার।
নষ্ট করেছে আমাদের
এই সুইচ এই ল্যাম্প এই আঁধার
চারপাশে আজেবাজে যত বিকার।
নষ্ট করেছে আমাদের
নষ্ট করেছে নষ্ট করেছে।
এই নেতার এই দল নেতার গলাবাজি  
এই অফিস এই ফাইল ফাইলে কারসাজি।
নষ্ট করেছে আমাদের
নষ্ট করেছে নষ্ট করেছে।
এই বাস এই ট্রাক রাজপথের যত
মাধবীদের জেগে থাকা রাত শত শত।
নষ্ট করেছে আমাদের
নষ্ট করেছে নষ্ট করেছে।
এই ক্লাস এই রুম ফন্দিবাজ স্যার
পুরোনো পচে যাওয়া বাসি লেকচার
নষ্ট করেছে আমাদের
নষ্ট করেছে নষ্ট করেছে।

এই রোদ বৃষ্টি এই রংধনু
নেশা নেশা চোখে দেখা তোমার ক্ষীণ তনু
নষ্ট করেছে আমাদের
নষ্ট করেছে নষ্ট করেছে।

মিথ্যে শ্লোগান আর মিছিলের লাশ
ভণ্ডামির রাজনীতি অস্ত্র সন্ত্রাস।
নষ্ট করেছে আমাদের
নষ্ট করেছে নষ্ট করেছে।
কাঁটাবনে ঘুপচি নিষিদ্ধ হাতছানি
প্রতিদিন প্রতিরাতের অভাব টানাটানি।
নষ্ট করেছে আমাদের
নষ্ট করেছে নষ্ট করেছে।

এই ঘুম নির্ঘুম চোখের অব্যক্ত কথা
প্রেম প্রেম খেলায় পাওয়া অযথা ব্যথা ।
নষ্ট করেছে আমাদের
নষ্ট করেছে নষ্ট করেছে”
হ্যালো, যায়েদ আমিন, এখন আর গান লেখেন না কেন? হোয়াট দ্যা ফাক আর ইউ ডুইং নাও?
এই গানটা সম্পর্কে একটা কথাই বলা যায়, ফাকিং ব্যাডএ্যাস! আমি খুবই কানেক্টেড ফিল করি গানটার সাথে। শুনেছিলাম আপনি একটি কনসার্টে একবার গানটি করেছিলেন। আর করলেন না কেন কোথাও বলুন তো?


৭। আমি চাই
 ২৪ বছর ধরে শুনছি। হ্যাঁ, ২৪ বছর ধরে একই রকম মুগ্ধতা নিয়ে এই গানটি শুনছি আমি। ‘তবুও’ এ্যালবামের এ পিঠের ৬ নম্বর গান। এটিও একটি লিরিক বিপ্লবের গান, এবং যথারীতি, অবমূল্যায়িত। এই গানের শুরুতে আপনার গিটার সোলো আর মিল্টন আকবরের ড্রামিং, কী যে করেছিলেন না আপনারা, কোনো মানে হয়! লিরিক ছিলো যতদূর মনে পড়ে বাপ্পী খানের।  
“জং ধরে যাক সবগুলো পিস্তলে
ড্যাম্প পড়ে যাক সবকটা বুলেটে
নলগুলো সব বাঁকা হয়ে যাক
কালো কালো রাইফেলের
অচেনা লাশগুলো ফিরে যাক
আপন ঠিকানায়
আমি চাই শুধু জীবনের কোলাহল
আমি চাই শুধু কোকিলের আগমন।
সুনীলের আনকোরা কবিতা
ভালোবাসাগুলো হয়ে যাক
হৃদয়ের মেঘে ছেয়ে যাক
জীবনের চাওয়া যতটুকু
ঝামেলাহীন হয়ে যাক
বৃষ্টিফোঁটা ধুয়ে দিয়ে যাক
হৃদয়ের যত কালো দাগ।
আমি চাই শুধু জীবনের কোলাহল
আমি চাই শুধু কোকিলের আগমন।

স্বপ্নগুলোর সময় কাটুক
রাত জাগানিয়া ছড়ায়
আকাশের বুকে সব আশা
নোঙ্গর করুক নিরাশা
ইচ্ছে যত আছে জীবনে
পূরণ হয়ে যাক সবই তা
হতাশা গুলো হয়ে যাক
এলোমেলো ঝরণা
আমি চাই শুধু জীবনের কোলাহল
আমি চাই শুধু কোকিলের আগমন”
৮। বিকেলের চানাচুর
 বাচ্চু ভাই, আগের লেখায় একটি ভুল করে ফেলেছিলাম। শুধুমাত্র আপনার গাওয়ার কথা লিখেছি, বাজানোর কথা বলাই হয় নি! আপনি যে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গিটারিস্ট, এই পরিচয়টা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। ক্ষমা করে দেবেন। একটা ঘটনা পড়লাম আজ। নিউইয়র্কের কোনো একটা অতি দামী গিটার স্টোরে ভয়াবহ দামী একটি গিটার পছন্দ হয়েছিলো আপনার। একটু দেখতে চেয়েছিলেন। নাক উঁচু সাদা চামড়ার লোকটি আপনার দেশ বাংলাদেশ শুনে বলেছিলো যে এত দামী গিটার বাংলাদেশের মত গরীব দেশের কারো কেনার সামর্থ্য নেই। আপনি বলেছিলেন, আপনাদের সবার কাছে যত টাকা আছে সব মিলে গিটারটা কিনে ফেলা যাবে। দোকানদার অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আপনাকে গিটারটি দিলো। আপনি করলেন কী, বাজানো শুরু করে দিলেন! বাংলাদেশের গিটারগডের বাজানো শুনে পুরো দোকান স্তব্ধ। সাদা চামড়ার অহংকারী লোকটা বিগলিত হয়ে বললো, আপনাকে অর্ধেক দামেই গিটারটা দিয়ে দেব। তা শুনে আপনি  জানালেন, যে গিটারের জন্যে আপনার দেশের অসম্মান হয়েছে, সে গিটার আপনি দ্বিতীয়বার বাজাবেন না। বিনা পয়সায় দিলেও না।   
আপনি যদি শুধু গিটার সোলো করতেন এবং তা যথাযথ প্রচার পেতো, আপনার নাম জো সাত্রিয়ানির সাথে উচ্চারিত হতো, এ আমার বিশ্বাস। ব্যাচেলর সিনেমাটিতে আপনার বাজানো গিটার ট্র্যাক বিকেলের চানাচুর শুনিয়ে দেই সবাইকে কী বলেন! এখন সন্ধ্যা পৌনে সাতটা। একটু চানাচুর তো হতেই পারে!
বিকেলের চানাচুর- https://soundcloud.com/hasan-mahbub-2/bikeler-chanachur-ab
৯। ও বন্ধু তোমায়
 এ গানটি যখন রিলিজ পায়, তখন আমার এ্যালবাম শোনার বয়স হয় নি। এটা শুনেছি অনেক পরে। পাবনায় শহীদুল্লাহ ভাইয়ের কাছে আপনার দ্বিতীয় একক এ্যালবাম ‘ময়না’ ছিলো। পাবনার এক গ্রামে বসে আমরা তখন সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা একজন শিল্পীর গান শুনছি, এখন ভাবতে গেলে গর্ব হয়। তখন অবশ্য ময়না গানটা শোনাটাই মূল আকর্ষণ ছিলো। সেও তো এক গানগল্প! গানের মাধ্যমে গল্প বলাটা তখন আর কেউ করতো কি? আমার মনে পড়ে না। ময়না গানটি কিছুটা পরিচিতি পেয়েছিলো, কিছু মানুষ শুনেছিলো। বাকি গানগুলো এখন কয়জন মনে রেখেছে জানি না।
ও বন্ধু তোমায় গানটিতে যে আক্ষেপ আর আকুলতা ছিলো সেটা সেই বয়সের আমার পক্ষে ধারণ করা সম্ভব ছিলো না। আর এখন, ধারণ করতে গিয়ে আমার সমস্ত অস্তিত্ব পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কী ভীষণ ভার এই বিষাদের!
আমায় কথা দাও, কখনও ছেড়ে চলে যাবে না...
বাচ্চু ভাই, আপনার কাছ থেকে এমন একটা প্রমিজ আদায় করে নি কেউ? তাহলে হয়তো আপনি এত তারাতাড়ি চলে যেতেন না...
১০। ধুলো মাখা পথ
 এই গানটি অপেক্ষাকৃত নতুন। ২০০৪-০৬ এর কোনো এক সময়ে বহুরূপী নামের এক মিক্সড এ্যালবামে প্রকাশিত। দেখেন অবস্থা বাচ্চু ভাই, আমার মনে নেই বলে যে ইন্টারনেটের তথ্যসমুদ্র থেকে দুই-একটি ক্লিকে জেনে নেবো সে উপায় নেই। সম্ভবত এ পিঠের দুই নম্বর গান ছিলো, তাই না? লিরিকটা কে লিখেছিলেন তাও মনে নেই। অসম্ভব রকম বিষণ্ণ এক গান। পুরো লিরিকটা আমার ডায়েরিতে লেখা ছিলো। সেই ডায়েরিটাও হারিয়ে ফেলেছি মনে হয়।
“ধূলো মাখা পথ, পথেরই মায়ায়
একলা আমার পথের পাড়ি,
দেশান্তরী মনটা এ বেলায়
বড় বেশি ফিরে যেতে চায় বাড়ি!
বন্ধু আমার, পথ চেয়ে থেকো
মাগো আমার, ভালোবাসা নিও
আশার গান, গাইছি আবার প্রিয়
বাড়ি ফেরা হবেই এবার জেনো...”
বাচ্চু ভাই, আমাকেও বাড়ি ফিরতে হবে এখন। আমি জানি বাড়ি ফেরার মত আনন্দের আর কিছু নেই। আমার প্রেমময়ী স্ত্রী, অপার্থিব আনন্দের উৎস দুই সন্তান, বাবা-মা, ভাই সবাই আছে। আমাদের ঘরে নতুন অতিথি এসেছে, আমি এখন বড় আব্বা হয়েছি। আপনি তার জন্যে আশীর্বাদ করবেন। এত প্রাপ্তি, এত পূর্ণতার মধ্যেও এখন বুকটা খা খা করে। আপনার জন্যে। আপনি তো জানেন আমার কতটা জুড়ে ছিলেন! বাচ্চু ভাই, এই ক্ষুদ্র লেখাটায় কিছুই লেখা হয় নি। অনেক অনেক গান, গল্প, স্মৃতি, উল্লাস, হেডব্যাং, পাগলামী, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের কথা বাকি থেকে গেছে। সারাজীবন ধরে বললেও শেষ হবে না। আমি তো আপনার মত পূর্ণকালীন শিল্পী না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কলম পিষি। তাই হয়তো আমি আপনাকে নিয়ে  এত এত  লিখতে পারবো না। তাতে কী, আপনার সাথে যোগাযোগ তো থাকবেই সবসময়, যেমনটা ছিলো গত ২৮ বছর ধরে!
ভালো থাকবেন। গুরু আজম খান আর প্রিয় লাকি ভাইকে আমার সালাম জানাবেন।

ইতি
আপনারই
হাসান মাহবুব 


(লিরিক কৃতজ্ঞতা- LRB Lyrics 

Comments

  1. "Tobuo" album ta kothao khuje pacchi na.. Can anyone plz suggest me whr can i find it...

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

ইলুমিনাতি, একটি মার্কেটিং টুল; অথবা ছহি ইলুমিনাতি শিক্ষা

জ্বী না, সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়!