কাঁচপুস্তকের খতিয়ান

(১)
ঘটনার বিবরণ ভালোভাবে না শুনলে অনেকে আমাকে গ্রীক পূরাণে বর্ণিত বিশেষ একটি চরিত্রের নামাশ্রয়ী মানসিক রোগী বলতে পারে। ভালোভাবে বুঝিয়ে বলার পরেও চিন্তার বিশৃঙ্খলায় হুটোপুটি খেয়ে অত্যন্ত জটিল এই আত্মানুসন্ধানকে তারা আওতার মাঝে না পেয়ে সরলীকরণ করে যাহোক কিছু একটা বুঝে নিয়ে নিজেদের জ্ঞানী ঠাওরাতে পারে। তাদের উচ্চমার্গের মনোবিশ্লেষণের যাঁতাকলে পড়ে আমি ব্যাপারটার উপসংহার টানবো এভাবে, "আরেহ...আমি তো মজা করে বলেছি এসব। অমন কিছু ঘটেনি।" উপসংহারের সাথের ক্রীয়াপদটি ভবিষ্যতকাল, কারণ এখনও ব্যাপারটা কাউকে বলিনি আমি। বলার মত কাউকে পাচ্ছি না। বলব যে সে সম্ভাবনাও নেই। এসব ব্যাপার কাউকে বলে সময় নষ্ট করার চাইতে অনুসন্ধানের অভিযাত্রী হওয়া ভালো। খুঁজে পাবার সম্ভাবনা যদিও খুব কম, তারপরেও আবছা ভাবে তার আবছায়া এসে আমাকে প্রায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিলে নিজেকে ভীষণ জ্যান্ত লাগে। পরক্ষণেই অবশ্য সে মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যায় বাতাসের তৈরি হাওয়াই মিঠাইয়ের মত, স্পন্দিত হৃৎকম্পনের স্পর্ধিত সাহস নিয়ে। আমাকে ক্লিন্ন এবং ক্লিষ্ট করে সে চলে যায়। তাকে ফিরিয়ে আনার রোখ আমার জীবনের চালিকাশক্তি হয়ে থাকে। ভবঘুরেদের মত এলোমেলো ঘুরতে থাকি সারাবেলা। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামীদের কেউ কেউ আশ্চর্য নির্বিকারতায় নিজের আসন্ন বিলীন নিয়তিকে মেনে নেয়। আমি জানি, আমিও সেরকম কোন গুরুদন্ডপ্রাপ্ত, হয়তোবা অভিশপ্ত। সুখী লেবাস পরিহিত এই আমি সানন্দে ছুড়ে ফেলতে পারি যাবতীয় দ্বিধার খোলস, ছুটে বেরুতে পারি বারণের নৃত্যবৃত্ত চপল পায়ে। পসরা সাজাচ্ছি বেচবো বলে, বাঁচবো বলে, তাকে নিয়ে। বারেবার ভেঙে পড়ে নির্মীয়মান ইমারত। এটা এক দিক দিয়ে ভালোই, বারেবার সাজানোর সুযোগ পাই আমি। তাকে সাজাতে আমার কখনও ক্লান্তি আসবে না, জেনে গেছি। বিষমপুরের বিবমিষা সে তোমাদের জন্যে গচ্ছিত রাখো। যখন আমাদের দুজনকে একসাথে দেখবে, যত পারো উগড়ে দিও হৃদম্লীয় তরল, ঈর্ষা এবং ঘেন্নার গরল। অবহেলার আস্তাকুড়েতে কম জায়গা রাখিনি তোমাদের জন্যে।
(২)
আমার স্ত্রী ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারেনি। সম্ভাব্য বুঝদারদের তালিকায় তার নাম অবশ্য প্রথমেই! আমার ভেতর লুকোবার কোন চেষ্টা নেই। তাই, হয়তোবা খুব সহসাই সে অনুধাবন করবে কী প্রবল একজন প্রতিপক্ষের উদয় হয়েছে তার জীবনে! প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিহিংসার পাশাপাশি সে অনুভব করবে দায়, এই অনভিপ্রেত আগমনে যা এড়ানোর সুযোগ নেই তার, অনুভব করবে মাঝেমধ্যেই খেলাচ্ছলে সহযোগিতা করে কী বিতিকিচ্ছিরি বিপদটাই না টেনে এনেছে! তখন কী আমি তাকে চলে যেতে দেবো? না। সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না। তার গোলাপী ঠোঁটে রক্ষিত আছে আমার পুণ্যের আমলনামা, দীর্ঘনিশির নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর সালতামামি, তার কাঁধ থেকে প্রজাপতি অথবা পরী বা পাখির মত ডানা বের হয়ে আমার ঘর্মাক্ত দেহ এবং নর্দমাক্ত মনকে হাওয়া দিয়ে উড়িয়ে দিত সমস্ত ক্লেশ এবং ক্লেদ। কীভাবে তাকে ছেড়ে যাই আমি অথবা তাকে ছেড়ে যেতে দিই? কিন্তু সে নিশ্চয়ই অন্য কারো সাথে ভালোবাসা ভাগাভাগি করতে রাজি হবে না। আর এতটুকু আত্মসম্মান যদি তার না থাকে তাহলে আমিই বা কী করে ভালোবাসি তাকে?
(৩)
ইদানিং আমি নিয়মিত শেভ করি, অনেক সময় নিয়ে। নিজের সৌন্দর্যের ব্যাপারে কখনই তেমন সচেতন ছিলাম না। এখনও যে হয়েছি তাও না। শেভ না করলেই আমাকে নাকি ভালো লাগে। বাকপটু সহকর্মীনি কটাক্ষ ভরে আমাকে "মাকুন্দা" নামক অপমানজনক আধা স্ল্যাং দিয়ে সম্ভাষণ করে, তার দিকে আমি তীর্যক দৃষ্টিতে তাকাই। কী এক অবাক ভালোবাসার পেছনে ছুটছি আমি তাকে বলে দেব? সে কী বুঝবে? সে কী ভুলে গেছে যে একদিন ক্লিনশেভড অবস্থায় অফিসে আসার পর আমার গাল থেকে বিচ্ছুরিত নীলচে আভা নিয়ে সে এক প্রস্থ প্রশংসাসূচক কাব্য পর্যন্ত করে ফেলেছিলো। ভুলে গেছে সে? হয়তোবা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু আমি মনে রেখেছিলাম। আমার স্ত্রীকেও বলেছিলাম সে কথা। সে ঈর্ষাণ্বিত না হয়ে বরং উসকে দিয়েছিলো আমাকে,
"বাব্বাহ! এরকম প্রশংসা তো আমি মেয়ে হয়েও কখনও পাইনি। তুমি যদি এখন ঘনঘন শেভ করা শুরু কর, তাহলে মোটেও অবাক হব না।"
যদিও তার পছন্দ ছিলো আমার কয়েকদিনের না কামানো মখমলের মত নরম দাঁড়ির স্পর্শ। তার কিছুদিন পরই আমি নিয়মিত শেভ করা শুরু করে দিই এবং আমার পরিবর্তনে সুন্দরী পৃথুলা কলিগের নির্লিপ্ততায় কতটা ব্যথিত হয়েছি তা করুণ স্বরে বর্ণনা করি। খেলাটা বেশ বিপদজনক ছিলো, সন্দেহ নেই, কিন্তু কীভাবে যেন, কী ভেবে যেন সে এই খেলাটা অনুমোদন করে এবং আমরা অনিয়মিত বিরতিতে খেলাটা খেলতে থাকি।
(৪)
একদিন রাত্তিরে, শোবার আয়োজন করার সময় আমার সদা পরিপাটি সহধর্মিনী যখন তার প্রসাধন সামগ্রীগুলো সাজিয়ে রাখছিলো যতন করে, তখন আমার মাথায় এক অদ্ভুত খেয়াল চেপে যায়। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে তার প্রসাধনসামগ্রীগুলো নিজে ব্যবহার করার ইচ্ছে ব্যক্ত করি। নতুন খেলার প্রস্তাবটি তার বেশ পছন্দ হয়। হয়তোবা এতদিন ধরে চলে আসা খেলাটির খেলুড়েদের সংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কা করেছিলো সে, দুই থেকে তিন...হতে পারে না? বৃহৎ মনের পরিচয় দেয়াটা সংকোচের আবরনে ঢেকে যাচ্ছিলো। নতুন খেলাটা হয়তোবা তাকে এবং আমাকে আসন্ন মনোমালিন্য এবং সন্দেহের বেড়াজাল থেকে মুক্তি দেবে, তাই সে বেশ উৎসাহ ভরেই রাজি হয়। আমার ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল আর কপালে একটা মস্তবড় টিপ দিয়ে সজ্জিত করার পর তার সে কী হাসি!
-দেখ, দেখনা একবার আয়নায় নিজেকে! উফ! মারা যাবো হাসতে হাসতে!
আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বটাকে বড় অচেনা লাগে। কোনরকম হাস্য উপকরণ খুঁজে পাইনা আমি। প্রথম দেখায় স্বভাবতই খুব অদ্ভুত লেগেছিলো, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই চোখটা ধাতস্থ হয়ে আমাকে জানান দেয় যে, মেয়ে হয়ে জন্মালে আমি কিরকম সুন্দর হতে পারতাম। হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। আমার মা'র স্টুডিওতে তোলা সাদাকালো ছবিগুলো দেখলে যে কেউ ধন্দ্বে পড়ে যাবে সেটা চিত্রনায়িকা ববিতার ছবি নাকি সাধারণ এক আটপৌড়ে ঘরের তরুণীর শখ করে তোলা ছবি, এ নিয়ে। সুতরাং, তার সন্তান যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হত তাহলে ডাকসাঁইটে সুন্দরী হত, এতে সন্দেহ কী? অন্তত আমার মুটিয়ে যাওয়া স্ত্রী'র চেয়ে ঢের সুন্দর হত। আমি বিহবল চোখে তাকিয়ে থাকি বেশ কিছুক্ষণ আয়নার দিকে। ওদিকে আমার স্ত্রী হেসে গড়িয়ে পড়ছে গায়ের ওপর।
-হয়েছে, হয়েছে এবার রাখ! আহা কী রূপ! ভাগ্যিস আমি লেসবিয়ান না!
আমি আমার খসখসে গালে এবং ঠোঁটের সন্নিকটের ওপরের অংশটুকুতে অসন্তোষে হাত বোলাই। শেভ করা হয়নি বেশ ক'দিন।
-এই খোঁচা খোঁচা অংশগুলো না থাকলে কিন্তু প্রায় পুরোপুরিই মেয়েদের মত লাগতো, তাই না?
-হ্যাঁ, তা ঠিক। একেবারে সোফিয়া লোরেন হয়ে যেতে!
-শেভ করে আসবো নাকি?
পুরাতন ফাজলামির বা খেলাটার প্রসঙ্গ তোলায় তার কিন্নর হাসিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে যেন। আশঙ্কাকে আবারও হাস্যরসের আবরণে মুড়িয়ে সে আমাকে ঘুমুতে যাবার আমন্ত্রণ জানায়।
-এসো গো সুন্দরী। শেভ করতে হবে না। আবার সেই পুরুষটা হয়ে যাও। ঘুমুতে যাবার আগে আমাকে একশটা চুমু খাও!
এ প্রস্তাবে অসম্মত হবার কোন কারণ ছিলো না। চুমু ছাড়াও শৃঙ্গারের যাবতীয় কলাকৌশল প্রয়োগ করে তাকে আমি অস্থির করে তুলি। এই অস্থির প্রবাহে ভেসে গিয়ে সে লক্ষ্য করেনি আমি অপলক চেয়ে আছি আয়নার দিকে, নিজের নতুন রূপ প্রত্যক্ষ করছি অবাক দৃষ্টিতে। সেদিনের মত সবকিছু সাঙ্গ হলে দাঁড়ি কামানো খেলাটার বিস্তারিত রূপ মনঃচক্ষে অবলোকন করে অদ্ভুত সব স্বপ্ন সম্বলিত একটি শিহরিত ঘুম দিই।
(৫)
-আপনাকে আজ বেশ অন্যরকম লাগছে। মাকুন্দা মাকুন্দা লাগছে না মোটেও। আমি আবার কাব্য করব আজ সেদিনের মতন!
ওহ! মনে রেখেছে তাহলে! কী কাব্যি করবে শোনার জন্যে আমি উৎকর্ণ হয়ে থাকি। কিন্তু সে আর কিছু বলে না। তাড়িয়ে তাড়িয়ে আমার আগ্রহ এবং অস্থিরতা উপভোগ করতে থাকে।
-হু! খুব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে তাই না?
আমার শুনতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি নিরুত্তর থাকি।
-এখন না, পরে বলব! অফিস টাইমে কী সবকিছু বলা যায়?
একদম প্রাণঘাতী ফ্লার্ট! প্রাণের সলতেয় জ্বলে ওঠে এক নতুন আগুন। অগ্নিবদ্ধ হয়ে কাটিয়ে দিই ব্যস্ত অফিস সময়। আমাদের মধ্যে আর কথা হয় না। প্রস্থানকালে, লিফটের আকাঙ্খিত নির্জনতায় সে শুধু একটি কথা বলারই সময় পায়,
"শেভ করলে আপনাকে কিন্তু বেশ লাগে।"
বাসায় যাবার পথে আমি সেলুনে যাই।
সেদিন রাতে স্ত্রীর সাথে আবারও সে পুরোনো ফাজলামো করি,
-জানো, আজকে শিমি আমার চেহারার যা প্রশংসা করল না!
-ওহ তাই নাকি! এখন কী হবে বেচারা আমার! তা কী বলল সে?
-কী বলল তা আঁচ কর দেখি! আমাকে দেখে বল। কিছু বোঝা যায়?
-উমম! তুমি শেভ করে এসেছো। কালকেই না করলে? আজকে আবারও!
খেলাটায় সে তেমন আমোদ পাচ্ছেনা বোঝা যায়।
-এমন সুন্দরী সহকর্মিনীর স্তুতিবাক্যের অমর্যাদা করি কী করে বল!
নীরবতার বাগানে অভিমান এবং ঈর্ষার থোকা থোকা কাঁটাযুক্ত ফুল ফুটতে থাকে। আমি সাবধানে হাতে নিই পুষ্পস্তবক। তাকে আহবান জানাই গতকাল রাতের সেই অদ্ভুত খেলাটি খেলার জন্যে। আজ রাতে খোঁচা খোঁচা পদার্থগুলো ঝঞ্ঝাট করবে না মোটেও। সে আমাকে সাজায়। আমোদ পেয়ে হাসে। ছবি তোলে। কিছু আদিরসাত্মক কথাবার্তাও বলে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি আয়নার সামনে। আমার ভেতরের নারীটাকে অনুভব করার চেষ্টা করি। তার অতনু অবয়ব যেন গুমড়ে গুমড়ে মরে আমার দেহের ভেতর, প্রকাশিত হবার জন্যে। আরেকটু, আরেকটু অন্যরকম হলে, আরেকটু কমনীয় হলেই তো আমার দ্বিপাশবেষ্টিত নারীদ্বয়, শিমি এবং সানজানাকে টপকে সুন্দরীতমা হতে পারতো সে! আমার ভেতরটা ফেটে যায়, ফেটে চৌচির হয়ে যায়, কিন্তু সে বের হয় না। আমি তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি, যাবতীয় স্পর্শচেষ্টা সানজানার কামজ দেয়ালে বাঁধা পেয়ে ফিরে আসে। ঘরের আয়নার সামনে বেশিক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। তাই আমি বাথরুমে যাওয়ার অজুহাতে অন্য আমি অথবা আমার একান্ত অন্য কাউকে উন্মোচন করতে চাই। আমি আরো একবার শেভ করি। সেই সাথে ভাবি, চুল কাটা বন্ধ করে দেব এখন থেকে।
(৬)
সানজানা দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছে। শিমি সুন্দর হচ্ছে। প্রায় সমানুপাতেই এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। সানজানার অতিমাত্রায় রুটিনবাঁধা গৃহী ভালোবাসা আর শিমির চকিতে দুয়েকটা রহস্যময় চোখভঙ্গি, ছিনালী বাক্যমদিরা পরিস্থিতিটাকে সহজেই একটা গতানুগতিক ত্রিভুজ প্রেমপোড়েনে পরিণত করতে পারতো, এবং সেখানে চালকের আসনে শিমি বসতে পারতো অনায়াসেই। বাঁধ সাধে আমার অন্তর্লীন নিজস্ব নতুন নারী। তার মাঝে কোন রহস্য নেই। তাকে আমি খোলা বইয়ের মতই পড়তে পারি, সেও আমাকে। সে সুন্দর, এবং তাকে সুন্দর করার প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন। সে একসময় সবার চেয়ে সুন্দর হবে। আমার চুলটা আরেকটু বড় হলে, চুলে রঙ করলে। সে ছাপিয়ে যাবে সবাইকে। শিমির রহস্যময় আহবান আর সানজানার প্রতি নির্ভরতা এ দুইয়ের সমন্বয়ে সে হবে অনন্যা। আমি তার অন্বেষণেই ব্যস্ত থাকি। তাই শিমির প্রতি আকর্ষণ সেভাবে জন্মায় না, সানজানার প্রতি বিকর্ষণও জাগেনা তেমন। এই যেমন-তেমন এর মাঝেও কিছু কিছু ঘটতে থাকে হয়তোবা...
-চুল বড় রাখাতে তোমাকে দারুণ লাগছে। একদম জনি ডেপের মত।
আমাদের সম্বোধন তুমিতে উন্নীত হয়। প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে আমার। বিশেষ করে শিমির কাছ থেকে। তবে তারচেয়েও বেশি আকাঙ্খিত নিজের কাছ থেকে নিজেকে! রাতের অপরূপ আঁধিয়ারিতে আমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারীর মুখ দেখতে পারি। ওহ খোদা! তুমি কেন আমার দুটো জন্ম দিলে না? আমি যে আর কাউকে ভালোবাসতে পারি না। নির্ভরতা আর কামাবেগের জোড়াতালি দিয়ে শিংমাছের মত দীর্ঘদিন প্রেমজলে জিইয়ে রাখা দুটো অসম্পর্ক অসহ্য লাগে এখন! শিমির দিকে আমি খরচোখে তাকাই।
-কী হয়েছে তোমার বলত আমাকে?
-তোমার খুব শুনতে ইচ্ছে করে, না?
প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপটা বেশ প্রকটভাবেই প্রকাশিত হয়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিমি। এমন সুরে কথা শুনে সে অভ্যস্ত না।
-তোমাকে বলব একদিন হয়ত সবই। হয়তো বা শুধু তোমাকেই।
-আমার সাথে রহস্য করবা না। স্পষ্ট করে কথা বলার সময় এসেছে এখন। তুমি কাকে চাও? সানজানা নাকি আমাকে?
-যদি বলি অন্য কাউকে?
-যদি টদি না, অন্য কেউ থাকলে সেটাও স্পষ্ট করে বল।
-বললে তুমি বিশ্বাস করবে? ব্যাপারটা যথেষ্টই উইয়ার্ড।
(৭)
শিমি মন দিয়ে আমার কথা শোনে। কফি এবং মুরগীর হাড্ডিগুড্ডিও হয়তো পাকস্থলীর ভেতর থেকে উদগ্র আগ্রহে ওঁত পেতে থাকে। এবং সে যথারীতি ভুল বোঝে। এই আখ্যানের একদম শুরুতে যা উল্লেখ করেছিলাম। সে আমার মনোবিকলনকে সরলীকরণ করে একটি গৎবাঁধা মানসিক রোগের নাম বলে যা গ্রীক মিথোলজি উদ্ভুত।
-ইউ আর নার্সিসিস্ট রাইট? সে তো আমিও। আমরা প্রায় সবাই।
-নার্সিসিস্ট হলে আমি নিজেকে ভালোবাসতাম, নিজের সকল কাজকর্মে মুগ্ধ হতাম, নিজের প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়তাম...
-হ্যাঁ, এখানে তো তাই হচ্ছে! তুমি আয়নায় নিজেকে দেখে নিজের প্রেমে পড়ে গেছ, একই তো ব্যাপার।
-আমি নিজেকে দেখিনি। নিজের প্রেমে পড়িনি।
-মানে? তাহলে কাকে দেখেছো? আচ্ছা, আবার গোড়া থেকে শুরু করা যাক ব্যাপারটা...
-শাট আপ স্টুপিড বিচ! ইউ উইল নেভার আন্ডারস্ট্যান্ড।
কাকে কী বলছি! আমি জানতাম কেউ বুঝবে না। কারো সাধ্যি নেই বোঝার।
(৮)
অথচ আমি নিজেই কি বুঝি নিজেকে? বছর পেরিয়ে গেছে। আমার যন্ত্রণা বাড়ছে। আমি পীড়িত হচ্ছি। নির্ভর নশ্বরতার উৎকেন্দ্রিকতা আমার অনিবার অনুরাগকে দলিত করছে। দর্পনের কাছে নিজেকে অর্পন করে দর্প চূর্ণ হয়েছে কেবল। আমার ভেতরের নারীটা আমায় দেখে হাসে এখন। স্পর্শের আড়ালে অগ্নীভুত অনুভূতিরা ভেজা কাঠ হয়ে থাকে। সেই ভেজা কাঠগুলো এখনও সানজানা এবং শিমির অর্ধ উত্তপ্ত চুলোয় বসিয়ে গরম করি। সে আমাকে তার অপারগতা জানিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে তার সীমাবদ্ধতার কথা। তাকে বন্দীশালা থেকে মুক্ত করার ক্ষমতা আমার নেই, সেও পারবে না বেরুতে।
-তো কী হবে? কী করব এখন?
-সানজানা অথবা শিমি যেকোন একজনকে বেছে নাও, একদম ভালো মানুষের মত। তারপর মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে খেলো।
-শাট আপ স্টুপিড বিচ! ইউ উইল নেভার আন্ডারস্ট্যান্ড।
আমি ভাবতেও পারিনি তুমিও বুঝবে না।
(৯)
তাই,
আমি...
একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম অবশেষে।
শিমির সাথে আমার গোপন সম্পর্কটা ঠিকই বজায় রাখবো, কিন্তু কোন শারীরিক ব্যাপার না। কারণ, আমি সানজানার প্রতি 'বিশ্বস্ত' থাকতে চাই।
সানজানার সাথে পুরোনো ফাজলামি, খেলাধুলো এসব বাদ দিয়ে তাকে ভালোবাসবো, এবং প্রচুর সেক্স করব। কারণ, আমি তাকে ভালোবাসি।
আর আমার সেই রহস্যময় নারী! তাকে অন্বেষণের চেষ্টা! শি! রিটার্ন অফ শি! নো ফাকিং ওয়ে। জাস্ট বাথরুমের আয়নার সামনে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে তাকে দেখে জার্ক অফ করব। সিম্পল!
(১০)
একদিন বাসায় এসে দেখি সবগুলো আয়না ভাংচুর করে গেছে কারা যেন। আর কোন ক্ষয় ক্ষতি হয়নি। সানজানা ঠিকই গুনগুন করে গান গেয়ে ঘরের কাজ করছে!
-আয়নাগুলো সব ভেঙে গেছে। কালকে মিস্তিরি ডাকিয়ে ঠিক করে নিয়ো।
আমি জানতে চাইতে পারতাম, কেন শুধু আয়নাগুলোই ভাঙলো, কেন অন্যান্য জিনিস অক্ষত থাকলো, কীভাবে এসব ঘটল, এতসব কিছুর পরেও সানজানা কেন এত নির্বিকার। জিজ্ঞেস করতে পারিনি সানজানার মুখে ক্রুর হাসি দেখে। আমি জানি, কালকে অফিসে গিয়েও সব কাঁচ ভাঙা দেখবো, এবং শিমিও এরকম ক্রুর হাসি হাসবে।
ঠিক আছে বালিকারা! আমি আত্মসমর্পণ করছি। তোমাদের দুজনের কাছেই। একদিন হয়তো শহরের সব বিপনী বিতান, ঘর, সেলুনের কাঁচ ভেঙে যাবে তোমাদের ইন্ধনে। তবে জেনে রেখো, ভাঙা কাঁচের টুকরোতেও কখনও দেখা যেতে পারে নিজের প্রতিবিম্ব, অনুভব করা যেতে পারে অনাস্বাদিত ভালোবাসা। গ্যালাক্সির প্রতিফলিত সমস্ত আলোর আল ধরে আমি অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবো না কখনও। তার দরকারও নেই। কাঁচপুস্তকে ইতিমধ্যেই মুদ্রিত হয়ে গেছে আমার অহমিকার খতিয়ান। তোমরা তা দেখতে পেলে তো!

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

মৃতবৎসা জোছনার কাল

তোমার জন্যে শুভ্র গোলাপ, বেড়ালতমা -হামিম কামাল