প্রলোভন এবং প্রায়শ্চিত্তের গল্প

পূর্বজন্মের মনোলগ

সব সময় এত সাবধান থাকো কেন তুমি? কীসের এত ভয় তোমার? পা ফসকাবার? পা ফসকালে কী হবে? অনেক নিচে নেমে যাবে, অনেক অনেক গভীরে পতিত হবে, এই তো? তারপর কী হবে? কোথায় যাবে? নরকে? নরক কে এত ভয় তোমার? হাহাহা...

খরগোশদের আবাসস্থল
একটি কামরা। বদ্ধ এবং বিষণ্ণ। কিছু আসবাব। না থাকলেও চলতো। ওক কাঠ দিয়ে বানানো পুরোনো দরোজায় লেপ্টে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক হাহাকার। এখানে থাকে ৩ জন খরগোশ, অথবা ৩ জন মানুষ, অথবা ৩ জন মানবসদৃশ খরগোশ, কিংবা খরগোশ সদৃশ মানুষ। বলা যায় যে কোন একটি। তাতে কেউ বাধা দেবে না, কেউ কিছু মনে করবে না, কারো কিছু এসেও যাবে না।
বৃষ্টি ঝরেছে আজ সারা দিন। মুষুলধারে নয়, আবার টিপটিপ ছন্দেও নয়। বৃষ্টি ঝরেছে তার ইচ্ছে মত। কাউকে তোয়াজ করে নয়। কারো মন ভালো করার জন্যে বা কারো মাঝে কাব্যভাব তৈরি করার জন্যে নয়। কাউকে বিষাদী বা স্মৃতিকাতর করার জন্যে নয়। কারো কোথাও যাবার তাড়া নেই, বলা ভালো; কারো কোথাও যাবার ইচ্ছেই নেই। কোথায় যাবে মনুষ্য খরগোশের দল? এই বদ্ধ ঘরের ভেতর যে দরোজাটা আছে তা শাবল দিয়ে আটকানো। শক্তিশালী ইস্পাত। ভারী কাঠ। তাই আর কেউ সেটা ভাঙার চেষ্টা করে নি। কেটলিতে পড়ে আছে এক শতাব্দী পূর্বের বিকটবিদঘুটেবিস্বাদ চা। কারো খেতে ইচ্ছে করে নি। কে ওই কেটলিটা এনে রাখলো, কেনই বা রেখেছে তারও কোন তথ্য নেই।
তারা তিনজন। একজন দরোজা সংলগ্ন আয়রন টেবিলটায় জামা-কাপড় ইস্ত্রি করছে। আর বাকি দুইজন সোফায় বসে আছে। তাদের প্রত্যেকের শরীর মানুষের, আর মাথাটা খরগোশের। এর জন্যে তারা আনন্দিত নাকি বিষাদগ্রস্ত তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই।
আয়রন করতে থাকা মানুষটির শরীরে মেয়েদের পোষাক পরানো। সোফায় বসে থাকা একজন মেয়ে, আরেক জন পুরুষ। ধরা যাক তাদের নাম যথাক্রমে রেখা, জুলেখা এবং একা।
কক্ষের ভেতরে যেন জায়গায় জায়গায় নিস্তব্ধতার মাইন পুতে রাখা। নিস্তব্ধতা হিমে হিমে বছরের পর বছর পার করে জমাট বেঁধে খাঁটি বিস্ফোরক হয়ে গেছে। হয়তো বা আর কিছুক্ষণ ভেন্টিলেটর থেকে নীরবতার শীত শীত হাওয়া এসে পৌঁছুলেই প্রাণ ফিরে পাবে বোমারু আসবাব গুলো। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র কখনই বাস্তবায়িত হয় নি। হবে না কখনও।
হয়তো।
-আজ সারাদিন বৃষ্টি হলো।
একা সোফা থেকে উঠে কে জানে কেন পায়চারি করতে লাগলো। সে হয়তো আশা করেছিলো এর জবাবে রেখা অথবা জুলেখা ভদ্রতাসূচক কোন প্রত্যুত্তর করবে অথবা সম্মতির সুরে মাথা নড করবে। এসব কিছু হয়েছিলো কি না তা অবশ্য জানার কোন উপায় নেই। কারণ একা সেটা খেয়ালই করে নি।
-ভুলে যেও না আজ শুক্রবার।
বেশ খানিকটা বিরতির পর রেখার গলা শোনা গেলো। রেখা আয়রন করছে তখনও। এটা একার কথার জবাব হলো, না কি আরো একটি মনোলগ, তা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এই কথাটি বলার পর অনেক দূর থেকে কারা যেন...
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
জুলেখা জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কি কেউ ফোন করেছিলো?

(২)
পূর্বজন্মের ডায়ালগ

-আজ বিকেলে পাখি শিকার করতে বেরুবো।
-কোন পাখি শিকার করবে তুমি নাগর? পাখাওলা নাকি পাখা ছাড়া?
-হাহাহা! তুমি কথায় কথায় যে মেটাফর গুলি ইউজ কর না, শুনতে বেশ মজা লাগে।
-আমি তোমার বন্দুক এবং আন্ডারওয়্যার পরিষ্কার করে রেখেছি।
-এজন্যেই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে।
-হ্যাঁ, আমিও বেশ উপভোগ করছি সম্পর্কটা।
-কোন সম্পর্কটা? আমার আর তোমার, নাকি আমার আর তার? অথবা তোমার আর তার?
খরগোশেরাও একসময় ব্ল্যাক মেটাল পছন্দ করতো
রেখা গুনগুন করে কী যেন গাইছে। একা কান খাড়া করে আছে সুরটা বোঝার জন্যে।
-এটা যেন কোন গান?
জুলেখা কৌতুহলী হয়ে উঠেছে বেশ। কিন্তু রেখা বা একা কেউ কোন উত্তর দিলো না।
সুরটা সংক্রামক। ওদের কে আক্রমণ করে বসলো অযথা। যেন জাগতিক মোহে উদভ্রান্ত মাতাল সন্ন্যাসীর অবিন্যস্ত ধ্যান। যেন গ্রীষ্মের দুপুরে হঠাৎ গাট্টি বোঁচকা নিয়ে নয় অতি শীত দেশে হাজির অতিথি পাখিদের বিষাদী অভিযাত্রার বয়ান। অথবা ওইজা বোর্ডে হঠাৎ ভর করে বসা পাপাচারীর নস্টালজিক অভিযাত্রার ভয়াল ফিসফিসে ছায়া বিবরণী।
নরওয়ে। কালো জাদুকরদের সুরের পসরা।
Burzum.
Dunkelheit
কয়েকটি মৃত্যু।  আগুনের সঙ্গমে ধর্ষিত চার্চ।
When night falls
She cloaks the world
in impenetrable darkness.
A chill rises
from the soil
and contaminates the air
suddenly...
life has new meaning
বিস্রস্ত ভাঁড়দের পাগলের মত ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যায় অমরত্বের অমীয় গরল পান করে থাকা ফ্রাস্ট্রেটেড কাপালিকের দল।  তবুও এই ঘরের নীরবতা কাটে না। জুলেখা আবারও প্রশ্ন করে বেরসিকের মত, বোকার মত
আজ কী বার? কয় তারিখ?
পরিপার্শ্ব আবারও ভারী হয়ে ওঠে কাদের যেন হাসিতে...

(৩)
পূর্ব জন্মের ট্রায়ালগ, অথবা ম্যাক্সিকান স্ট্যান্ড অফ

-আমি কতবার, বার বার করে বলেছি, ওর কাছে যাবে না। ও একজন কালো জাদুকর। ও তোমাকে প্রাচীন জাদুঘরে বন্দী করে রাখবে। হাজার চাইলেও মুক্তি পাবে না।
-কিন্তু আমি শুনেছি ও নাকি কম দামে ভায়াগ্রা বিক্রী করে।
-তোমার ভায়াগ্রা কেনার দরকার নেই। আমার দরকার একটা ভালো মানের বটি আর কিছু স্নাফ ফিল্মের সিডি।
-আর আমার দরকার একটা টেলিস্কোপ।
-টেলিস্কোপ দিয়ে কী করবে শুনি? যতসব উদ্ভট আবদার তোমার।
-আশ্চর্য! তোমাদের যা যা দরকার তা বলতে ক্ষতি নেই, আর আমি কিছু একটা চাইলেই যত সব বায়নাক্কা?
-টেলিস্কোপের অনেক দাম।
-ভায়াগ্রাও কম দামী নয়।
- আর স্নাফ ফিল্ম? ওসব তো কালোবাজার ছাড়া পাবেই না।
-হ্যান্ডস আপ, আর একটা কথা বললে আমার স্বল্পত্থিত লিঙ্গ দিয়ে তোমাদের সবাইকে আঘাত করবো।
-হ্যান্ডস আপ! আর একটা আবদার করলে আমার ঝুলন্ত স্তন দিয়ে তোমাদের পিষে মারবো।
-হ্যান্ডস আপ! আর এক পা এগুলে আমার পায়ের প্লাস্টার দিয়ে সবাইকে আঘাত করবো।
নারকীয় স্তব্ধতার সাড়ম্বরে অনুতাপহীন কিছু প্রাণের র‍্যান্ডম উক্তি এবং দর্শক প্রতিক্রিয়া
-আই হ্যাভ আ সিক্রেট।
-আই হ্যাভ আ সিগ্রেট।
-লেটজ গো টু দ্যা সেক্রেটারিয়েট।
-সেক্রেটারিয়েট শুক্রবারে বন্ধ থাকে না?
(প্রচণ্ড হাসির শব্দ)
-কটা বাজে এখন?
(শুনে ‘ওরা’ হাসিতে ফেটে পড়লো)
-আমার ধারণা এটা দক্ষিণ পাইকপাড়া
(ভীতিকর হাসির শব্দ)
-এটা ইস্ট লন্ডন হবার সম্ভাবনাই বেশি।
(তরল হাসির ঢেঊ বয়ে গেলো)
-না, এটা প্রাক্তন রোডেশিয়া।
(প্রাণ খুলে হেসে নিলো ‘ওরা’)
-আমি বুঝতে পেরেছি ওরা কখন এবং কেন হাসে।
(প্রশংসা সূচক অব্যয় এবং হাত তালি)
-আমি আগে থেকেই জানতাম।
(বিস্ময় সূচক অব্যয় এবং হাত তালি)
-আমিও জেনে ফেলবো শিঘ্রই।
(হাত তালির শব্দে তিষ্টোনো দায়)
-আজ অনেক বৃষ্টি হয়েছে।
-সেদিনও অনেক বৃষ্টি ছিলো।
-আর মাটি ছিলো স্যাঁতস্যাতে এবং নরম।
-আর তাই কোঁদাল চালাতে ওদের খুব সুবিধে হয়েছিলো।
-রক্ত সহজেই ধুয়ে মুছে গিয়েছিলো।
-ওরা এক যোগে প্রার্থনা করেছিলো।
-হাস্যকর ভাড়ামী। এর চেয়ে মলয় রায় চৌধুরির হাংরি বুলেটিন পড়ে শোনালে ভালো হতো।
-কিংবা যদি পড়তো বার্বি গার্লের স্মৃতিকথা...
-কেউ যদি সঙ্গোপনে প্রার্থনা বইয়ের মধ্যে পর্ন পুস্তিকা ভরে দিতে পারতো...
-আমার সিক্রেট ফুরোলো বট গাছটি মুড়োলো।
-আমার সিগ্রেট শেষ হবে, ক্যাকটাস ফুটবে বাথটাবে।
-আমি এসবের শেষ দেখতে চাই। আগামী মাসের তৃতীয় তরশু কালে আমি সেক্রেটারিয়েট যাবো।
(শ্রদ্ধামিশ্রিত হাত তালি, যা কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিণত হলো বিদ্রপাত্মক হাসিতে। কে যেন সময়টাকে ধরে চাবকাতে লাগলো, আর তা দেখে ‘স্থান’ বারবার মুর্ছা যেতে লাগলো।)

যোগসূত্র

-ক্যাচক্যাচ শব্দ হচ্ছে কোথাও।
-কেউ আসছে।
-কেউ আসছে?
-অদ্ভুত ব্যাপার! এখানে গত তিন হাজার বছরে কেউ আসে নি।
-ভুল। আমি এসেছি মাত্তর তিন মাস আগে।
-আরে নাহ! সংখ্যাটা আদতে হবে তিন কোটি বছর।
-অদ্ভুত ব্যাপার! কেউ হাসলো না এবার!
-হ্যাঁ, স্থান-কাল সম্পর্কিত কোন কথা শুনলেই ওরা...
সে কথা শেষ করতে পারলো না। দরোজা ক্যাচক্যাচ করতে লাগলো প্রচণ্ড শব্দে। বহুকালের অব্যবহারে ক্লান্ত কেঠো শরীর পোয়াতি শূকরের মত ঘোঁৎঘোঁৎ করতে লাগলো। খুব অস্পষ্ট ভাবে ধীরে ধীরে খুলতে থাকলো দরোজা টা। কেউ আসছে, কেউ একজন আসছে! দরোজা খুলছে, খুলছে, খুলছে...হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার। তিনটে মানব খরগোশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে কে? কেন? কীভাবে?

পরিশিষ্ট
কোন এক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে শুয়ে আছে ভ্যালেন্তিনা রুকাইয়া তন্দ্রা ইউলিয়া লিং চি...
দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত। সংজ্ঞাহীন। লাইফ সাপোর্ট দেয়া। আচমকা সে চোখ মেললো। দেখলো দরোজা খুলে ঠান্ডা মাথার এক খুনী কসাই আসছে নানাবিধ যন্ত্রপাতি নিয়ে। আজরাঈল আসছে ডাক্তারের ছদ্মবেশে। ভীষণ জোরে চিৎকার করে উঠলো সে। আর দৃশ্যান্তর থেকে কে বা কারা যেন বলে উঠলো,
-স্বাগতম!

ডেভিড লিঞ্চের "Rabbits" অবলম্বনে

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

ইলুমিনাতি, একটি মার্কেটিং টুল; অথবা ছহি ইলুমিনাতি শিক্ষা

জ্বী না, সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়!