জেমস র‍্যান্ডি-এ্যান অনেস্ট লায়ার!


ভদ্রলোক একটু কুঁজো হয়ে হাঁটেন। বয়স নব্বইয়ের কোঠায়। অশক্ত একজন বৃদ্ধ। কিন্তু তার চেয়ে প্রতাপশালী কাউকে আমি অনেকদিনের ভেতর দেখি নি। অনেকদিন কাউকে দেখে এত সম্ভ্রম জাগে নি! ভদ্রলোক একজন পেশাদার জাদুকর এবং এস্কেপ আর্টিস্ট ছিলেন। জাদুকরদের রাজা হুডিনির রেকর্ড ভেঙে টেঙে একাকার করেছেন। তার বিভ্রম তৈরির ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। চাইলেই মাইন্ড রিডিং, সাইকিক পাওয়ার, টেলিকাইনেসিস এর মত বিষয়াদীকে পুঁজি করে দারুণ ব্যবসা ফেঁদে মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি করলেন উল্টোটা। তথাকথিত প্যারানরমাল বিষয়ের প্রমাণ দেখাতে পারলে এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করলেন। দুঃখের বিষয়, ধড়িবাজ প্রতারকেরা কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় নি। সিলভিয়া ব্রাউন নামক এক মহিলা, যিনি নিজেকে 'মিডিয়াম' হিসেবে দাবী করেন- অর্থাৎ যিনি মৃতদের সাথে তার আত্মীয়দের কথা বলিয়ে দেন, অথবা কারো পূর্বজন্মের কথা বলে দেয়ার মত বিশাল কাজকর্ম করেন, তিনি একবার তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী বছরগুলিতে তার আর খোঁজ পাওয়া যায় নি। তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, তিনি নাকি তার সাথে যোগাযোগ করার উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। যে মহিলা মৃতদের ঠিকানা খুঁজে পান, তার কাছে জেমস র্যান্ডির ঠিকানা নেই! হাস্যকর না?

ভদ্রলোকের নাম জেমস র্যান্ডি! তথাকথিত প্যারানরমাল একটিভিস্ট, সাইকিক পাওয়ার সম্পন্ন ধড়িবাজ, অসৎ জাদুকরদের যম। যারা বিভিন্ন বিভ্রমের কৌশল দেখিয়ে নিজেকে রহস্যময় এবং শক্তিধর প্রমাণে ব্যস্ত, জেমস র্যান্ডির কাছে তাদের একটু আসতে বলবেন, দেখবেন, পালানোর পথ পাবে না প্রতারকেরা!

জেমস র্যান্ডিকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম দেখলাম। নাম- এ্যান অনেস্ট লায়ার। নামটি যথাযথ। জাদু তো একধরণের মিথ্যাই! সেই মিথ্যাকেই ভালোবেসেছিলেন জেমস। তবে অন্যান্য জাদুকরদের সাথে তার পার্থক্য হলো, তার জাদুকে তিনি স্রেফ কিছু বিভ্রম কৌশল হিসেবে অবিহিত করেন, এর মধ্যে কোন রহস্যময়তা আরোপ করেন না।

জেমস র্যান্ডি জীবনে অসংখ্যবার প্যারাসাইকোলজিস্ট, সাইকিক, মিডিয়াম, হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, এদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন। সিনেমাটিতে তার কয়েকটি অধ্যায় দেখানো হয়েছে মাত্র।

হোমিওপ্যাথি নিয়ে বেশি কিছু বলা নেই, অল্প কয়েক সেকেন্ডে দেখানো হয়েছে, তিনি একটি শো'তে ঢকঢক করে হাই পাওয়ারের হোমিওপ্যাথির ঘুমের ঔষধ খেয়ে নিচ্ছেন, এবং দিব্যি কথা বলছেন। টেড টকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ আছে। হোমিওপ্যাথি নিয়ে বিস্তারিত আরেকদিন বলবো।

সেবার ৩৫ হাজার বছর বয়স্ক একজনের খোঁজ পাওয়া গেলো। তাকে মহা সমাদরে বিভিন্ন শোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে নানারকম বুজরুকি করে দেখাচ্ছে, আর বোকা জনগণ ধন্য ধন্য করছে খুশিতে! অস্ট্রেলিয়া থেকে তাকে আহবান জানানো হলো এটা ডিবাংক করার জন্যে। তিনি বললেন, কেউ ৩৫ হাজার বছর বয়সী হিসেবে নিজেকে দাবী করলে সে যে মিথ্যে বলছে, এটা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা গেলেও হাতেকলমে প্রমাণ করা সম্ভব না। তাই করলেন কী, নিজেই এরকম একটি চরিত্র তৈরি করলেন। তার পার্টনার হোসে আলভেজকে কার্লোস নাম দিয়ে জাতিস্মর চরিত্রে অভিনয় করালেন মিডিয়াতে। এবং যথারীতি,সবাই খুবই প্রীত! হলভর্তি মানুষ বেরিয়ে এসে বলছে, হ্যাঁ তারা বিশ্বাস করেছে! জেমস র্যান্ডি এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন, মিডিয়ায় মিথ্যা প্রচার করলে তা কীরকম ম্যানিপুলেটিভ হতে পারে! তিনি জয়ী হয়েছিলেন।

এরপর ধরলেন আরেক ধড়িবাজকে। যে নাকি সাইকিক শক্তি দিয়ে হাতের স্পর্শ ব্যতীত বইয়ের পাতা ওল্টাতে পারে! তো তাকে নিয়ে আসা হলো লাইভ টিভিতে। সে যদি জেমস র্যান্ডির শর্ত মেনে চোখের শক্তি দিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টাতে পারে, তাহলে ১০,০০০ ডলার পুরস্কার পাবে। জেমস র্যান্ডি করলেন কী, বইয়ের চারপাশে ভেজা ফোম ছড়িয়ে দিলেন। ব্যাস, সাইকিকের খেলখতম! সে আর কিছুতেই কিছু করতে পারে না! সবার সামনে লজ্জিত হতে হল তাকে।

জেমস র্যান্ডি পরিচিত হতে থাকলেন দ্যা এ্যামাজিং র্যান্ডি নামে। এবার তার প্রতিপক্ষ একজন ইসরায়েলি যুবক। নাম তার ইউরি গেলার। সেও কিছু সাইকিক পাওয়ার টাওয়ার ধারণ করে আর কী! দশটি গোলকের ভেতর একটিতে একটা বস্তু রাখা থাকলে সে বলে দিতে পারে কোনটিতে আছে। এই খেলা দেখিয়ে সে অনেক 'সুনাম' অর্জন করলো। খেলা দেখাক, ঠিক আছে, কিন্তু ঠগবাজটা বলে বেড়াতে লাগলো যে সে তার সাইকিক পাওয়ার দিয়ে এসব করে, এবং এগুলির ছাইপাশ সব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দিতে থাকলো। বড় বড় প্রতিষ্ঠান তার সাইকিক পাওয়ার কাজে লাগানোর জন্যে বিভিন্ন প্রজেক্টে নিতে শুরু করলো। চতুর ইসরায়েলি ধনে-ধানে ফুলে-ফেঁপে একাকার! জেমস র্যান্ডির মোটেও ভালো লাগলো না ব্যাপারটা। তিনি তাকে আবারও লাইভ টিভিতে নিয়ে এলেন, এবং তার যন্ত্রের সেটআপ একটু বদলে দিলেন। ব্যাস, ধরা খেয়ে গেলো জোচ্চোরটা!

তবে সিনেমায় যেমন হয়, বাস্তবে তেমন হয় না। ধরা খাবার পরে ইউরি গেলার কিছুদিন পরে চামচ বাঁকানোর খেলা শুরু করলো। তার উপস্থাপনা ছিলো অসাধারণ। আর মানুষ তো বোকা বনতে প্রস্তুতই থাকে! তাই তার ব্যবসা দিনদিন আরো বড় হতে লাগলো। দ্যা এ্যামাজিং র্যান্ডি শেষতক একটি বই'ই লিখে ফেললেন ইউরি গেলারের জোচ্চুরি নিয়ে- "The Truth About Uri Geller" শিরোনামে। যাই হোক, এখন ইউরি গেলার নিজেকে আর সাইকিক হিসেবে পরিচিত করে না। নতুন ভঙ ধরেছে। এখন সে নিজেকে বলে মিস্টিফায়ার। জানি না আই ছাতামাথার মানে কী!

জেমস র্যান্ডির সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট ছিলো পিটার পপঅফের ধাপ্পাবাজী ধরিয়ে দেয়া। এই ধূর্ত জার্মান বিশাল হলরুমে হাজারো মানুষের সামনে দৈবচয়নে কারো নাম ধরে ডেকে তার ঠিকানা, রোগ, সব বলে দিতেন। মিলেও যেত সব! অলৌকিক ছাড়া আর কী! জ্বী না, দ্যা এ্যামাজিং র্যান্ডিকে মানানো অত সহজ না! তার দলবল আবিষ্কার করলো যে পিটারের কানে একটি ইয়ারবাড থাকে। ইয়ারবাড কেন? এবার তার একটু বাইরের সাহায্য দরকার পড়লো টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলির সমাধানের জন্যে। তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ারকে ডাকলেন। একদিন পিটার পপঅফের শোতে তিনি ছদ্মবেশে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে চলে এলেন। যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে দেখলেন যে, পিটারের স্ত্রী রেডিও ফ্রিকুয়েন্সি ব্যবহার করে পিটারকে সমবেত জনতার মধ্যে থেকে একেকজনের হদীশ বলে দেন। সামনের সারিতে অমুক জামা পরা অমুকের কী সমস্যা, নাম কী, কোথায় থাকে, ইত্যাদি। তার স্ত্রীই বা কীভাবে জানেন? খুব সহজ। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আগে তাদেরকে একটি ফর্ম পূরণ করতে হয়। সেখানেই সব লেখা থাকে।

ধরা খাওয়ার কিছুদিন পর পিটার পপঅফ নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। তবে কিছুদিন পর আবারও নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করে।

দ্যা এ্যামাজিং র্যান্ডির আরেক প্রতিপক্ষও অবশ্য থেমে থাকে নি। ইউরি গেলার তার বাকপটুতা, এবং কিছু কৌশল দেখিয়ে এখনও চালিয়ে যাচ্ছে ব্যবসা। সে বলে থাকে জেমস র্যান্ডির বই নাকি তার ভালোই করেছে, প্রচার হয়েছে। এ্যান হনেস্ট লায়ার সিনেমাটিতেও সে আসার সাহস দেখিয়েছে, এবং এই কথাগুলি বলে গিয়েছে।

জেমস র্যান্ডিও চমৎকার কথা বলেন অবশ্য। তার বক্তৃতা মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। তবে তিনি কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী। তার এক মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার কিন্তু এখনও উন্মুক্ত আছে। কেউ এখনও সেটা নিতে পারে নি। আপনি একটু চেষ্টা করে দেখবেন নাকি?

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

ইলুমিনাতি, একটি মার্কেটিং টুল; অথবা ছহি ইলুমিনাতি শিক্ষা

জ্বী না, সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়!