বেটস মেথড এর আবিষ্কারক উইলিয়াম বেটস এবং তার যাবতীয় নির্বুদ্ধিতা




ভয়ংকর একটা পোস্ট ভাইরাল হবার পথে এগুচ্ছে। এটাকে এখনই থামান, নইলে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন! https://www.facebook.com/groups/EngineersDiaryFamily/permalink/2116901885046208/
 পোস্টটা দেখেছি ইঞ্জিনিয়ারস ডায়েরি নামক এক গ্রুপে। বিষয়বস্তু হলো, কীভাবে মাইওপিয়া বা দৃষ্টিক্ষীণতা প্রাকৃতিক উপায়ে নিরাময় করা যায়। পোস্টদাতার ভাষ্যমতে মাইওপিয়ার কারণে চশমা নেয়ার কোনই দরকার নেই, এবং চশমা দেয়াটা ডাক্তারদের এক ধরণের ষড়যন্ত্র। সমাধান খুবই সহজ। “এই সমস্যা সমাধান করতে আমাকে বদ-অভ্যাস বাদ দিয়ে টানা ৭ দিন রুটিন করে ৪০০-৫০০ মিটার দূরের কোনো কিছুর দিকে একটানা ৪০-৫০ মিনিট তাকিয়ে থাকতে হবে। চোখ ঠিক হয়ে যাবে”।
তাই! কীভাবে সম্ভব এটা?
মাইওপিয়া হয় মূলত চোখের গঠনগত ত্রূটির কারণে। আপনার চোখের মনি যদি বেশি স্ফীত হয়, অথবা কর্নিয়ার গঠনে যদি ত্রূটি থাকে, তাহলে আলো কর্নিয়া থেকে চোখের লেন্স হয়ে রেটিনাতে যথাযথভাবে ফোকাস না করে তার একটু আগে প্রতিবিম্ব তৈরি করে। এর ফলে সৃষ্টি হয় ঝামেলা।
এখন চোখের এই গঠনগত ত্রূটি কি দূরের বস্তুর দিকে টানা তাকিয়ে থেকে দূর করা সম্ভব? যদি তা হয়, সেটা কীভাবে? কোন উপায়ে এই ত্রূটি নির্মূল হয়? আমি বুঝতে পারছি না।
মাইওপিয়া ঠিক করতে আপনাকে দেয়া হবে অবতল লেন্সের চশমা, যা আপনার রেটিনার ঠিক জায়গায় আলো ফোকাস করে দিবে। চশমা নিবেন, এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের কী আছে বুঝলাম না!  
তবে আপনার যদি মন চায়, আপনি দূরের দৃশ্য দেখেন মনোযোগ দিয়ে ৭ দিন ধরে, ৪০ মিনিট করে। এতে আমার কিছু বলার নাই। ঠেকায় পড়লে ঠিকই চশমা নিতে হবে।
যে কারণে পোস্টটি ভয়াবহ বললাম, তা হলো এর দ্বিতীয় পরামর্শটি। সূর্যের দিকে প্রতিদিন খালিচোখে ৫-১০ মিনিট তাকিয়ে থাকলে নাকি চোখ ভালো হয়ে যায়। কী সর্বনাশ! সূর্যের আলোতে যে আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি থাকে, তা তো একদম অন্ধই করে দিতে পারে চোখকে! গ্যালিলিও যেভাবে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজের চোখ খুইয়েছিলেন শেষ বয়সে!
পোস্টদাতা বলছেন, “আমরা এতকাল জেনে সূর্যের এসেছি সূর্যের UV রশ্নী চোখের জন্য ক্ষতিকর কিন্তু গবেষনায় গেছে যে তা চোখের সমস্যা দূর করে এবং চোখ ভালো রাখে (ঘাঁটাঘাঁটি করলে জানতে পারবেন। প্রায় ১২ প্রকার প্রাণির উপর পরীক্ষা করা হয়েছে)” (বানানের অবস্থা করুণ, যাই হোক!)
আমিও বলছি, ঘাঁটাঘাঁটি করুন। প্লিজ ঘাঁটাঘাঁটি করুন। ঘাঁটাঘাঁটি করে জানুন। যদি হাউশ হয়, তো ইউভি রশ্মি চোখের ভেতরে নিয়ে চোখ জ্বালিয়ে দিয়েন, কে মানা করেছে! তবে আপনাদের সুবিধার জন্যে আমি একটি লিংক দিয়ে দিচ্ছি। WHO (World Health Organisation) এখনও চোখের ওপর ইউভি রশ্মির উপকারিতা খুঁজে পায় নি,  তারা সেই আদ্যিকালেই রয়ে গেছে! চোখের ক্যান্সার, অন্ধত্ব ইত্যাদির জন্যে ইউভি রশ্মিকে তারা দায়ী করছেন। কী অন্যায়! এই লিংকে দেখুন- https://www.who.int/uv/faq/uvhealtfac/en/index3.html  

এখন কথা হচ্ছে, পোস্টদাতা কিছুদিন ধরে ইন্টারনেট ঘেঁটে এইসব তথ্য পেয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, এর পেছনে দায় কার? দায় হলো জনাব উইলিয়াম হোরাশিও বেটসের।  এই আমেরিকান ভদ্রলোক একজন চক্ষু চিকিৎসক ছিলেন। তো হঠাৎ করে তার মতিভ্রম হলো। তিনি মনে করলেন, চিকিৎসকেরা ভুল উপায়ে সমাধান খুঁজছে। তার মনে হলো, এইসব চশমা-ফশমা দিয়ে কিচ্ছু হবে না। প্রাকৃতিক সমাধান দরকার। তার জন্যে তিনি কীভাবে কীভাবে যেন একটি বিকল্প “চিকিৎসা পদ্ধতি” আবিষ্কার করে ফেলেন, যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, কীভাবে কাজ করে বলা নেই, সুফলের প্রমাণ নেই, কিচ্ছু নেই। এটাকে বলা হয় বেটস মেথড (Bates method)
এই অপচিকিৎসা পদ্ধতি থেকেই পোস্টদাতা কথাগুলি পেয়েছেন। উইকিপিডিয়াতে List of pseudosciences এ চিকিৎসা বিজ্ঞান অংশে হোমিওপ্যাথি, আকুপাংচার, ইত্যাদির সাথে সগর্বে বেটস সাহেবের মেথড অবস্থান নিয়ে আছে। দেখুন এখান থেকে- https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_topics_characterized_as_pseudoscience
বেটসের থিওরি খুব সহজ সরল। তার ধারণা ছিলো, অক্ষিগোলকের চারপাশের মাংশপেশী অক্ষিগোলককে নিষ্পেষিত করে, চেপে ধরে, এ কারণে দৃষ্টিশক্তি একেকজনরে একেকরকম হয়। এখন আপনার দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে হলে অক্ষিগোলকের আকৃতি বাড়াতে হবে।
আর এজন্যে চশমা, সার্জারি, কিচ্ছু লাগবে না। কিছু সেলফ রিলাক্সেশন এবং ভিজুয়ালাইজেশন এক্সারসাইজ করলেই হবে। তিনি দাবী করতেন, তার এই পদ্ধতি দিয়ে মাইওপিয়া তো বটেই, কালার ব্লাইন্ডনেস, গ্লুকোমা সব সারানো যাবে।
তার পদ্ধতির মধ্যে চারটি পর্যায় ছিলো। Palming, Swinging and shifting এবং  Sunning.
খালি চোখে সূর্যের দিকে তাকানোর এই মহাতরিকা বেটস সাহেব দিয়েছেন  Sunning নামে। তিনি মনে করতেন সূর্যের আলো চোখের জন্যে ভালো, এবং এতে চোখের সর্বরোগের উপশম হয়। পরবর্তীতে অবশ্য সংশোধন করে বলেন যে শুধুমাত্র চোখের সাদা অংশ দিয়ে তাকানো যাবে।
যাই হোক, সে যাই বলুক, যে যাই বলুক, সূর্যের দিকে ভুলেও তাকাবেন না। এমন কি সানগ্লাস পরেও না।
১৯২০ সালে The Cure of Imperfect Sight by Treatment Without Glasses নামক বইয়ে তিনি এই কথাগুলি লিপিবদ্ধ করেন। ১৯২৯ সালে মারা যান, কিন্তু কিছু মানুষ তার এই অদ্ভুত থিওরি জিইয়ে রাখে। এখনও রেখেছে!
বলাই বাহুল্য, তার এই থিওরি চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা কখনই মেনে নেন নি। তবে অপবিজ্ঞানকে লুফে নেয়া কুসংস্করাচ্ছন্ন মানুষ এখনও জিইয়ে রেখেছে এই বিদ্যা, এবং ছড়িয়েও যাচ্ছে!
বিস্তারিত পড়তে এই দুটি লিংকে চলে যান

আর কেন সূর্যের দিকে তাকানো যাবে না আরো ভালোভাবে বুঝতে চাইলে এই ভিডিওটি দেখুন।
সামনে চক্ষু চিকিৎসা বিষয়ক আর কী কী অপচিকিৎসা আসতে পারে জানতে এই লিংকে ক্লিক করুন- https://www.quackwatch.org/01QuackeryRelatedTopics/eyequack.html

তবে কমনসেন্স বাড়ানোর সহজ তরিকা জাতীয় কোন লিংক দিতে পারছি না বলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
এর পরেও  যদি মনে করেন যে চক্ষু চিকিৎসকদের এত বছরের পড়াশোনার চেয়ে কিছুদিন ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে অদ্ভুত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে আসা এক ছোকড়ার কথাই বেশি নির্ভরযোগ্য, শেয়ার করে ছড়িয়ে দিতে হবে তাহলে নিকটস্থ গবাদি পশুর ডাক্তারের সাথে এখনই যোগাযোগ করুন!  

Comments

Popular posts from this blog

প্যাথেটিক হোমিওপ্যাথি, কেন বিশ্বাস রাখছেন!

ইলুমিনাতি, একটি মার্কেটিং টুল; অথবা ছহি ইলুমিনাতি শিক্ষা

জ্বী না, সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় ভাষা বাংলা নয়!